কলকাতার যুবভারতী স্টেডিয়ামে ঢোকা থেকেই লিওনেল মেসিকে ঘিরে রইলেন কর্তা-মন্ত্রীরা। মোটা টাকায় টিকিট কেটে গিয়েও প্রিয় তারকাকে দেখতে না-পাওয়া দর্শকদের ক্ষোভ আছড়ে পড়ল মাঠে। বোতল পড়ল। গ্যালারির চেয়ার ভেঙে ভেঙে মাঠে ফেলা হল। ফেন্সিংয়ের গেট ভেঙে শয়ে শয়ে দর্শক ঢুকে পড়লেন মাঠে। পুলিশ লাঠিচার্জ করে তাদের ফেরানোর চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। কার্যত রণে ভঙ্গই দিতে হয়েছে নিরাপত্তারক্ষীদের। সব মিলিয়ে লন্ডভন্ড যুবভারতী স্টেডিয়াম।
এদিকে, যুবভারতীতে লিওনেল মেসির অনুষ্ঠান ঘিরে বিশৃঙ্খলা নিয়ে ব্যথিত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ক্ষমা চেয়ে নিলেন ফুটবল-তারকার কাছে। সোসাল মিডিয়ায় এক পোস্ট করে জানালেন, যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে শনিবার সকালে যে ‘অব্যবস্থা’ হয়েছে, তার জন্য তিনি ‘স্তম্ভিত এবং বিচলিত’। এই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গড়েছেন তিনি। তদন্তে নেতৃত্বে দেবেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। সকল ক্রীড়াপ্রেমীর কাছেও ক্ষমা চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

মুখ্যমন্ত্রী এক্স অ্যাকাউন্টে লেখেন, সল্টলেক স্টেডিয়াম শনিবার যে অব্যবস্থা দেখা গেল, তাতে আমি বিচলিত এবং স্তম্ভিত।’’ তার পরেই তিনি জানান, মেসিকে একঝলক দেখার জন্য মাঠে যখন হাজার হাজার দর্শকের জমায়েত হয়েছিল, তখন তিনিও সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। সূত্রের খবর, বিশৃঙ্খলার খবর শুনে মাঝপথ থেকেই ফিরে যান মমতা। এর পরেই নিজের পোস্টে মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমা চেয়ে নেন মেসির কাছে।
তিনি লেখেন, এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্য আমি লিওনেল মেসি, সকল ক্রীড়াপ্রেমী এবং তার ভক্তদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
জানা গেছে, শনিবার ঠিক সকাল ১১.৩০ মিনিটে যুবভারতীর মাঠে ঢোকে মেসির গাড়ি। তার সঙ্গে ছিলেন লুইস সুয়ারেজ এবং রদ্রিগো ডি’পল। ফুটবলপ্রেমীদের উন্মাদনা দেখে উচ্ছ্বসিত দেখায় মেসিকে। তবে গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু মানুষ ঘিরে ধরেন তাকে। ফলে গ্যালারি থেকে শুধু মেসিকে নয়, লুইস সুয়ারেজ় এবং রদ্রিগো ডি’পলকেও দেখা যায়নি। এক সময় ক্ষুব্ধ ফুটবলপ্রেমীরা ‘উই ওয়ান্ট মেসি’ স্লোগান দিতে শুরু করেন।

মেসি যুবভারতীতে পৌঁছোতেই অন্তত ৭০-৮০ জন মানুষের ভিড় ঘিরে ধরে তাকে। মূলত মন্ত্রী, কর্তারাই ঘিরে ধরেন মেসিকে। অনেকে প্রায় প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারের মতো এলএম টেনের শরীরে ঘেঁষে ছিলেন। মেসিকে ভাল করে হাঁটার জায়গাটুকুও দিচ্ছিলেন না কেউ কেউ! ক্যামেরা এবং মোবাইল হাতে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মেসিকে ঘিরে রাখেন নিরাপত্তারক্ষীরা। অপ্রীতিকর কোনও পরিস্থিতি তৈরি না হলেও তারা আয়োজকদের ভিড় সরানোর অনুরোধ করেন। গ্যালারি থেকে তাকে দেখা যাচ্ছিল না। টিকিট কেটে মেসিকে দেখতে যাওয়া ফুটবলপ্রেমীদের ভরসা ছিল স্টেডিয়ামের তিনটি জায়ান্ট স্ক্রিন।

মোহনবাগান এবং ডায়মন্ড হারবারের প্রাক্তন ফুটবলারদের সঙ্গে মেসি পরিচিত হওয়ার সময়ও ভিড় ঘিরে ছিল তাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এবং প্রধান আয়োজক শতদ্রু দত্তকে মাইক্রোফোনে ঘোষণা করতে হয়। তাতেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। কারণ, মেসি যে ১৬-১৭ মিনিট মাঠে ছিলেন, সেই সময় গ্যালারি থেকে এক বারও দেখা যায়নি তাঁকে।

১১.৫২ মিনিটে মেসিকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। তখনও পর্যন্ত মাঠে এসে পৌঁছোননি মুুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শাহরুখ খান বা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। আর্জেন্টিনার তারকা মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মোটা টাকায় টিকিট কিনে মাঠে এসেও মেসিকে দেখতে না পাওয়ায় ফুটবলপ্রেমীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। শুরু হয় গ্যালারিতে লাগানো হোর্ডিং ভাঙচুর। পরে গ্যালারির চেয়ার ভেঙে মাঠে ছুড়তে শুরু করেন ক্ষুব্ধ ফুটবলপ্রেমীরা। মাঠে পড়তে শুরু করে বোতল। এই সময় গ্যালারিতে কোনও পুলিশকর্মীকে দেখা যায়নি। মেসিকে দেখতে না পাওয়ার হতাশায় ক্রমশ বাড়তে থাকে উত্তেজনা। এক সময় মাঠের ধারে ফেন্সিংয়ের গেট ভেঙে হু-হু করে মাঠে লোক ঢুকতে শুরু করে। প্রথমে পুলিশ ছিল দিশাহারা। কিছুটা পর সম্বিত ফেরে পুলিশকর্মীদের। লাঠি উঁচিয়ে ক্ষুব্ধ জনতাকে তাড়া করে গ্যালারিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফুটবলপ্রেমীরা আবার মাঠে ফিরে আসেন। সব মিলিয়ে যুবভারতী রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়।
মাঠের দখল নিয়ে নেয় অন্তত হাজার দুয়েক লোক। মাঠে ঢুকে কেউ ডিগবাজি খেয়েছেন, কেউ সেল্ফি তুলেছেন, কেউ আবার লাফিয়েছেন। কয়েক জনের হাতে দেখা গিয়েছে গেরুয়া পতাকাও। বলা ভাল, যুবভারতী স্টেডিয়ামে মাঠে যে যা খুশি করেছেন। শেষ পর্যন্ত র্যাফ নামাতে হয় গ্যালারিতে। ব্যবহার করতে হয় কাঁদানে গ্যাস। পুলিশ-জনতা খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মেসি বিমানবন্দরের পথে রওনা হয়ে যাওয়ার পরও যুবভারতীয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি পুলিশ-প্রশাসন।

ফুটবলপ্রেমীদের ক্ষোভ মূলত নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে। তারা ফুটবলের রাজপুত্রকে ঘিরে থাকার জন্যই গ্যালারি থেকে তাকে দেখা যায়নি। চড়া দামে টিকিট কিনেও মেসিকে তাদের দেখা হল না।
অনেকের বক্তব্য, ফাঁকা মাঠে কয়েক জন নিরাপত্তারক্ষীকে দিয়ে মেসিকে মাঠের চার দিকে মিনিট পাঁচেক ঘোরালেই সকলে ভাল করে দেখতে পেতেন। কিন্তু তেমন কোনও ব্যবস্থাই করা হয়নি। মাঠের মাঝখানে ৭০-৮০ জন লোক মেসিকে ঘিরে রেখে সাধারণ ফুটবলপ্রেমীদের বঞ্চিত করেছেন। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু পরিকল্পনাহীনতার ছাপ দেখা গেছে। সব মিলিয়ে মেসির সফর ঘিরে লজ্জায় পড়তে হল কলকাতাকে।
এদিকে পশ্চিবাঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই বিশৃঙ্খলার তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করেছেন তিনি। কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অসীমকুমার রায়। কমিটিতে থাকবেন মুখ্যসচিব, অতিরিক্ত মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্র এবং পার্বত্য বিষয়ক বিভাগ।
মুখ্যমন্ত্রী জানান, এই ঘটনায় বিশদ অনুসন্ধান করবে কমিটি। যাঁরা দায়ী, তাদের চিহ্নিত করা হবে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সুপারিশ করবে।
সুত্র : আনন্দবাজার
কালের সমাজ/এসআর


আপনার মতামত লিখুন :