এক সময় উপকূলের দাকোপ ছিল দারিদ্র্য ও দুর্যোগের প্রতীক। লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস আর বাধ ভাঙ্গা নোনাপানিতে ভেসে যাওয়া ফসল সব মিলিয়ে জীবনের প্রতিটি দিন ছিল সংগ্রামের। কিন্তু এখন দৃশ্যটা বদলে গেছে। চরডাঙ্গা, তিলডাঙ্গা, কামারখোলা, মশামারী, বটবুনিয়া, জয়নগর, হোগালবুনিয়া, মৌখালি, রেখামারি এসব গ্রামের একসময়কার অনুর্বর জমি এখন সবুজ ফসলে ভরপুর। জলবায়ু সহনশীল কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ করে এখানকার মানুষ বদলে দিয়েছেন নিজেদের ভাগ্য। আর সেই পরিবর্তনের নেতৃত্বে আছেন গ্রামের নারী কৃষকেরা।
দাকোপ উপজেলার চরডাঙ্গা গ্রাম চারপাশে লাউ, ঢেঁড়শ, কুমড়ো, টমেটো, মরিচ,বেগুনের ক্ষেত; মাঝখানে ঝিলজমাট মাছের ঘের। কয়েক বছর আগেও এই জমি ছিল নোনা পানিতে ডুবে থাকা অনুৎপাদনশীল ভূমি। এখন তা পরিণত হয়েছে আয়ের উৎসে, ফসল আর মাছের রাজ্যে। এই দৃশ্য যেন এক জীবন্ত উদাহরণ কীভাবে জলবায়ু সহনশীল কৃষি একটি সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা পাল্টে দিতে পারে।
চরডাঙ্গার গৃহবধূ সুচিত্রা রানি রায় বলেন, আগে আমাদের সংসারে কষ্ট ছিল, খাবার-পোশাকের অভাব ছিল। স্বামী দিনমজুর, আমি ঘরে বসে থাকতাম। এখন লিজ নেওয়া জমিতে সবজি চাষ করছি, মাছ চাষ করছি। সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে, নিজের উপার্জনে এখন আমি গর্বিত। সুচিত্রা জানান, তিনি স্থানীয় এনজিও জেজেএস এর সহায়তায় জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। শিখেছেন কীভাবে লবণাক্ত মাটিতে জৈব সার ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে বাঁধের পাশে সবজি চাষ করলে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতি কম হয়। এখন তিনি শুধু নিজে নয়, প্রতিবেশী আরও কয়েকজন নারীকে নিয়ে যৌথভাবে কাজ করছেন। দাকোপের তিলডাঙ্গা ইউনিয়নসহ কয়রার ৪ হাজারেরও বেশী বহু নারী এখন স্বাবলম্বী। তারা জমি লিজ নিয়ে শাকসবজি ও মাছ চাষ করছেন। স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছেন নিজ হাতে উৎপাদিত পণ্য।
তিলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জালালউদ্দিন গাজী বলেন, আগে এই এলাকায় লবণাক্ততার কারণে কিছুই হতো না। মানুষ কাজের অভাবে অন্য এলাকায় চলে যেত। এখন জলবায়ু সহনশীল কৃষি পদ্ধতি চালু হওয়ায় চাষাবাদ ফিরেছে, আয় বেড়েছে, মানুষ ফিরে আসছে গ্রামে। তিনি আরও বলেন, এই পরিবর্তন শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক দিক থেকেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করায় পরিবারে পারস্পরিক সহযোগিতা বেড়েছে, শিক্ষার হারও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের এই রূপান্তরে কাজ করছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা। তাদের অন্যতম কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটির প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. মাছুমুর রহমান বলেন, আমরা উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকা বৈচিত্র্য বাড়ানোর দিকে জোর দিচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করা, যাতে কোনো দুর্যোগে তাদের আয় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দ্রুত পুনরুদ্ধার করা যায়। তিনি জানান, তাদের প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের জলবায়ু সহনশীল বীজ, জৈব সার, পানি সংরক্ষণ প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। অনেক নারী কৃষক এখন নিজের উৎপাদিত সবজি স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে মাসে ৮ থেকে ১০হাজার টাকা আয় করছেন।
দাকোপের কৃষকেরা এখন বুঝে গেছেন, প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ নয়, বরং অভিযোজনই টিকে থাকার উপায়। এখন তারা চাষ করছেন লবণ সহনশীল জাতের ধান, পাশাপাশি বাঁধের উপর সবজি চাষ ও মাছ চাষমিলিয়ে ইন্টিগ্রেটেড ফার্মিং সিস্টেম চালু করেছেন। এতে এক জমি থেকে একাধিক উৎসে আয় হচ্ছে। তিলডাঙ্গা গ্রামের কৃষানী আশালতা রায় বলেন, আগে প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়ে ফসল হারাতাম। এখন জলবায়ু সহনশীল চাষ শিখে ক্ষতি কমে গেছে। একই জমিতে সবজি ও মাছ চাষেআয় দ্বিগুণ হয়েছে।
এভাবে কৃষকেরা তাদের জীবনযাত্রায় নতুন দিগন্ত খুলেছেন। এখন দাকোপের স্থানীয় বাজারে প্রতিদিন সকাল থেকেই ব্যস্ততা দেখা যায় নারী কৃষকেরা নিজ হাতে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করছেন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। জলবায়ু সহনশীল কৃষি কেবল আর্থিক নয়, সামাজিক পরিবর্তনও এনেছে দাকোপে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এনজিও কর্মকর্তারা জানান, কৃষি আয় বাড়ায় এখন গ্রামের মানুষ আগের চেয়ে বেশি শিশুদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। অপরাধ প্রবণতা কমেছে। শিখা রায়,শিল্পী মন্ডল,শিখা রানী গোলদার সবাই হাসিমুখে বলেন, আগে আমরা কষ্টে বাঁচতাম, এখন নিজের হাতে ফলানো ফসল বিক্রি করে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাই। এটা আমাদের জন্য গর্ব।
অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার ফলে নারীরা পারিবারিক সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখছেন, সমাজে তাদের মর্যাদা বেড়েছে। একসময় যারা কেবল সংসারের বোঝা মনে হতো, এখন তারাই পরিবারের চালিকা শক্তি।
খুলনা জেলার উপকূলীয় এই উপজেলা এখন ধীরে ধীরে টেকসই উন্নয়নের একটি সম্ভাবনাময় মডেল হয়ে উঠছে। স্থানীয় কৃষি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দাকোপে সবজি ও মাছের সম্মিলিত উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। এর একটি বড় অংশ এসেছে জলবায়ু সহনশীল কৃষি পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিবর্তনকে স্থায়ী করতে হলে আরও কিছু পদক্ষেপ জরুরি। তার মধ্যে রয়েছে উপকূলীয় এলাকায় টেকসই অবকাঠামো ও পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, সংরক্ষণাগার ও বাজার সংযোগ স্থাপন,এবং দুর্যোগ-পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসন তহবিল গঠন।
তিলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জালালউদ্দিন গাজী বলেন, কৃষকেরা এখন অনেক কিছু জানে, তারা কাজও করছে। কিন্তু টেকসই হতে হলে সরকারি সহায়তা দরকার বিশেষ করে বাঁধ মেরামত, বীজ ও সার সরবরাহে সহায়তা। তাহলে দাকোপ শুধু জেলা নয়, দেশের জন্যও উদাহরণ হতে পারে।
বেসরকারি সংস্থাগুলোও বলছে, স্থানীয় সরকার, দাতা সংস্থা ও কৃষি সম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। কারণ, উপকূলীয় এই মানুষদের টিকে থাকার লড়াই কেবল তাদের নয় এটি সমগ্র দেশের খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গেও সম্পর্কিত।
দাকোপের চরডাঙ্গা গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে সন্ধ্যা নামে ধীরে ধীরে। ফসলের ক্ষেতের পাশ দিয়ে ফিরছেন নারী কৃষক সুচিত্রা রানি, কাঁধে তোলা ঝুড়িতে নিজের উৎপাদিত সবজি। মুখে ক্লান্তির ছাপ, তবুও চোখে আছে একরাশ আত্মবিশ্বাস। তিনি বলেন, ঝড় আসবে, বৃষ্টি আসবে এগুলো আমাদের জীবনের অংশ। কিন্তু এখন আমরা জানি, আবারও ফসল ফলবে, আবারও সবুজ ফিরে আসবে। দাকোপের এই গল্প কেবল একটি গ্রামের নয় এটি বাংলাদেশের উপকূলীয় মানুষের সংগ্রাম, অভিযোজন ও আশার গল্প। যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে মানুষ হার মানেনি, বরং প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে গড়ে তুলেছে টেকসই জীবনের নতুন অধ্যায়।
কালের সমাজ/ সাএ
আপনার মতামত লিখুন :