বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) চাঁদপুর কার্যালয়ে গাড়ির নিবন্ধন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, নম্বর প্লেট সংযোজন ও মালিকানা হস্তান্তরসহ বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে এসে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এই কার্যালয়ে এলে দালালদের দেখলে মনে হবে, তারা দপ্তরেরই চাকরি করে। কর্মচারীদের সঙ্গে বাইরের লোকদের যোগসাজশে অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে এই দপ্তর। সরেজমিনে গিয়ে এ কার্যালয়ে কয়েক দিন অবস্থান করে সেবা নিতে আসা লোকজন, দালাল চক্রের সদস্য ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, এই দপ্তরে সরকারি কর্মচারী তিনজন। কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন মোটরযান পরিদর্শক এবং অপরজন সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার)। এ ছাড়া দৈনিক হাজিরাভিত্তিক একজন কর্মচারী কাজ করেন। তাদের বাইরে দালাল হিসেবে অফিসের চেয়ার-টেবিল ব্যবহার করে কাজ করেন মো. শহীদ, মো. শাহজাহান, মো. মানিক ও মোহাম্মদ আলী। এসব দালালের বাইরেও গ্রাহকদের কাছ থেকে কাজ করার বিনিময়ে দালালি করার জন্য আসেন অটোরিকশাচালক শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা রিপন ও ট্রাক-লরি শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা মন্টু।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দৈনিক হাজিরাভিত্তিক কর্মচারী জিয়া হক হলেন অফিসের সব অনিয়মের সমন্বয়ক। তাকে সহযোগিতা করেন শহীদ, শাহজাহান, আলী ও মানিক।
সেবা নিতে আসা একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, সরকারি ফি পরিশোধ করার পরও বিভিন্ন অজুহাতে হয়রানির শিকার হতে হয়। অথচ দালালের মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা দিলে খুব সহজেই কাজ হয়ে যায়।’
ফরিদগঞ্জ থেকে আসা এক গ্রাহক জানান, চাঁদপুরের সুমাইয়া মোটরসের মাধ্যমে তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ১২ হাজার টাকা দিয়েছেন। তার লাইসেন্সের পাওয়ার ক্ষেত্রে সব কাজ তারা করে দেবেন।
এ শহরের যে কয়েকটি মোটরসাইকেল বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে, সবগুলোর বিক্রয়কর্মী কিংবা ম্যানেজারই হচ্ছেন এই দপ্তরের দালাল। তারা মোটরসাইকেলের নিবন্ধনপ্রতি অতিরিক্ত ১ হাজার টাকা দেন বিআরটিএর দপ্তরে। বিআরটিএর কার্যালয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছেন শহরের স্টেডিয়াম রোডের হিরো নিলয় মোটরসাইকেল শোরুমের ম্যানেজার নয়ন। এ বিষয়ে একাধিক মোটরসাইকেল বিক্রয় কেন্দ্রের বিক্রয়কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, বিআরটিএর অফিস অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়ে তারাও প্রতিকার চান।
এদিকে ফিঙ্গার প্রিন্ট নিতে আসা লোকজন প্রতি সপ্তাহের নির্ধারিত দিনে এই কার্যালয়ে আসেন। সেখানে থাকে একাধিক দালাল। নম্বর প্লেট লাগানোর কাজ করেন মোহাম্মদ আলী। তিনি হলেন দালালদের একজন। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভেতরে উপআনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো অফিসের পিয়ন এবায়েদুল হক। তিনি ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে আসা লোকদের কোনো ঝামেলা ছাড়া লাইসেন্স করে দেওয়ার চুক্তি করেন।
এবায়েদুল হক বলেন, ‘এখানে যারা আসেন তাদের কাজের চুক্তি করে দিলে ২০০ টাকা করে পাই।’ তিনি তাৎক্ষণিক সরকারি টেলিফোন ব্যবহার করে দালাল আলীকে নিয়ে আসেন দ্বিতীয় তলায়। আলী সাংবাদিক দেখে কেটে পড়েন।
আরেক দালাল মানিকের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এখন কাজ করি না। চিকিৎসার জন্য এসেছি। এমনিতে অফিসের সামনে বসে আছি।’ দপ্তর ছেড়ে চলে যান দালাল শহীদ। তিনি বলেন, ‘ভাই আমার বিষয়ে কিছু লিখবেন না।’ আরেক দালাল শাহজাহান। তিনি প্রাইভেট কার দিয়ে পরীক্ষা নেন। সেখানে জনপ্রতি নেন ২০০ টাকা। তিনি ক্ষমতাধর আত্মীয়-স্বজনের পরিচয় দেন।
দালাল মোহাম্মদ আলীকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘আপনি এই দপ্তরের কোন পদে চাকরি করেন?’ এ কথায় তিনি এলোমেলো উত্তর দিয়ে কেটে পড়েন। জানা গেছে, তিনি নম্বর প্লেট লাগানোর কাজ করেন। সেখানেও লোকদের জিম্মি করে ২০০ টাকার জায়গায় ৪০০ টাকা নেন।
দফতরের দৈনিক হাজিরার কর্মচারী জিয়া হক সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে তথ্য সংগ্রহের সময় বারবার বাধা দেন। অন্য এক সাংবাদিককে দিয়ে ফোন করিয়ে জিজ্ঞেস করান ‘কেন এই বিআরটিএর দপ্তরে যাওয়া হয়েছে? সেখানে সাংবাদিকের কাজ কী?’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই দপ্তরের অনিয়মের চিত্র আনতে গেলে সাংবাদিকদের বিভিন্ন উপায়ে ম্যানেজ করেন জিয়া হক। দালালদের মাধ্যমে জিয়া হকই সব কাজ সম্পন্ন
করেন। তার শক্তি হিসেবে আছে কথিত কয়েকজন সাংবাদিক। তাদের নিজস্ব সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও গাড়ি আছে। সেগুলো নিবন্ধন ছাড়া গাড়ি। জিয়া হক বলেন, ‘আমি কোনো অনিয়মে নেই। আমি সবার সঙ্গে ভালো আচরণ করি।’
দফতরের অধিকাংশ সময় উপস্থিত থাকেন মোটরযান পরিদর্শক আলা উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমি ৫ মাস আগে এই কার্যালয়ে যোগ দিয়েছি। অনিয়ম থাকতে পারে, তবে আমার চোখে পড়েনি।’
বিআরটিএ চাঁদপুর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমি দুই জেলার দায়িত্বে আছি। লক্ষ্মীপুর জেলায় কাজ করতে হয়। আবার চাঁদপুর কার্যালয়ে আসি। এই কার্যালয়ের যেসব অনিয়মের কথা জানতে পেরেছি, খোঁজখবর নিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করব।’
কালের সমাজ//র.ন
আপনার মতামত লিখুন :