সিরাজগঞ্জের বেলকুচি একটি নাম, একটি গর্ব। দেশের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, তানজিম, থ্রি-পিস, সব ধরনের তাঁতজাত পণ্যের প্রাণকেন্দ্র। যে হাতগুলো একসময় দেশের মেলা মাতাতো নিজেদের তৈরি করা বয়নশিল্প দিয়ে, আজ সেসব হাতই পরিশ্রম করে যাচ্ছে মহাজনের সুদের জাল টানার জন্য।
একসময়ের শিল্প আরেকসময় বেদনার নাম । বেলকুচি এলাকায় হাজার হাজার তাঁতি পরিবার তাঁত শিল্প নির্ভর। তাঁত শব্দটা এখানে শুধু একটি পেশা নয়। এটি জীবন, এটি ঐতিহ্য। কিন্তু আজ সেই শিল্প বিপন্ন।বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড থেকে নেওয়া ক্ষুদ্র ঋণ বহু তাঁতিই সময়মতো পরিশোধ করতে পারেননি। অভাব, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, বাজারে পাইকারি দামের পতন, আর মহাজনদের সাথে অসহনীয় শর্তে ব্যবসা করতে করতে অনেকেই ভেঙে পড়েছেন। ফলে সরকার আর নতুন ঋণ দিচ্ছে না। সরকারি ঋণের দরজা বন্ধ। দাদনের সুদের জাল: যেখানে কাঁথা বোনে ঋণ, রুটি নয় সরকারি ঋণ বন্ধ হতেই তাঁতিরা পড়েছেন আরও ভয়ানক এক চক্রে মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের দখলে।
তাঁত চালাতে প্রয়োজন: সুতার টাকা, রং ও কেমিক্যাল, শ্রমিকের মজুরি ও বিদ্যুৎ বিল । এসব খরচ জোগাতে তাঁতিদের দরজায় হাজির হয় দাদনের মানুষ। প্রথমে একটু নরম সুদের আশ্বাস, তারপর সপ্তাহ শেষে ১৫-২০% পর্যন্ত চড়া সুদের দাবী।
এই ঋণের চাপে অনেকেই: বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন , একের পর এক তাঁত বন্ধ করে দিয়েছেন। পরিবার নিয়ে কিস্তির দুঃস্বপ্নে দিন কাটাচ্ছেন ।
"আমার বাপ তাঁত করতো, আমিও করছি। কিন্তু এখন মনে হয়, আমার ছেলে যেন আর না করে..." এভাবেই চোখের কোণে জল নিয়ে বললেন বেলকুচির প্রবীণ একজন তাঁতি ।"আগে একটা শাড়ি বুনলে দুইবেলা ভাত হতো। এখন একটা শাড়ি বুনলেও রাতে ঘুম হয় না, কিস্তির চিন্তায়।"
জানা গেছে, বেলকুচিতে প্রায় ৮ হাজার তাঁতির দেখভাল ও ঋণ বিতরণের দায়িত্ব তাঁত বোর্ডের বেসিক সেন্টারের৷ প্রয়োজনের চেয়ে লোকবল কম থাকায় প্রতিষ্ঠানটি তাঁতিদের কাছে পড়ে থাকা ঋণ আদায় ও নতুন ঋণ বিতরণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না৷
২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হওয়ার পর ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত উপজেলার ২৫০০ জন তাঁতিকে প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে ৷ যার মধ্যে ১২০০ তাঁতির ঋণ বকেয়া পড়ে আছে ৷ ফলে তারা নতুন করে আর ঋণ নিতে পারছেন না।
তাঁত বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ২০ বছর আগে তাঁত বোর্ড দুটি প্রকল্পে তাঁতিদের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে ৷ একটি প্রকল্পে পিটলুম তাঁতের বিপরীতে ১০ হাজার, সেমি অটো তাঁতের বিপরীতে ১৩ হাজার ও বেনারসি তাঁতের বিপরীতে ১৮ হাজার টাকা ও আরেক প্রকল্পে তাঁতি শ্রেণিভেদে কমপক্ষে ৫০ হাজার থেকে আড়াই লাখ ও ৩০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা ঋণ প্রদান করা হয়।
ক্ষুদ্র তাঁতিরা জানান, গত কয়েক বছরে সুতা, রংসহ তাঁতসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁতপ্রতি বিনিয়োগ কয়েক গুণ বেড়েছে। এতে অনেক কষ্ঠ করে পাওয়া ঋণের টাকায় তাঁত চালু করতে না পেরে খুব কষ্ঠে দিনাতিপাত করছে তারা। দিন যত যাচ্ছে দারিদ্রতা ততই গ্রাস করছে ।
বেলকুচি বেসিক সেন্টার সূত্রে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী তাঁতিদের ঋণ পেতে হলে তাদের পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডভিত্তিক পর্যায়ের প্রাথমিক তাঁতি সমিতির সদস্য হতে হয়। বেলকুচিতে ৩৮টি সমিতি রয়েছে। সমিতির আওতাভুক্ত কোনো তাঁতি ঋণ গ্রহণে ইচ্ছুক হলে তাকে সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে বেসিক সেন্টারে আবেদন করতে হয়। বেসিক সেন্টারের কর্মকর্তারা সরেজমিনে তাদের অবস্থা দেখে ঋণ অনুমোদনের জন্য তাঁত বোর্ডে পাঠিয়ে দেন ৷ তাঁত বোর্ড থেকে মঞ্জুর হলে বেসিক সেন্টারের মাধ্যমে তাঁতিদের সেই ঋণ কৃষি ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় থেকে তুলতে হয় ৷ পরে উত্তোলিত ঋণ ৫ শতাংশ সুদে তিন বছরের মধ্যে মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে হয় ৷
তবে ঋণ গ্রহণকারী তাঁতিরা দৈনিক কালের সমাজকে জানান, ঋণের জন্য আবেদন করার পর ঋণ পেতে কত দিন লাগবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই অনেক সময় দু-এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও তাঁত বোর্ড থেকে ঋণের অনুমোদন আসে না ৷ এভাবে অনেকেই একসময় ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে আশা ছেড়ে দেন৷ এদিকে নিয়মানুযায়ী, কোনো সমিতির সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা ঋণের ৬০ ভাগ আদায় না হলে ওই সমিতির আর কোনো সদস্যকে নতুন করে আর ঋণ দেওয়া হয় না। সিংহভাগ সমিতির ৬০ ভাগ ঋণ আদায় না হওয়ায় বর্তমানে এই ঋণ দেওয়া বন্ধ রয়েছে।
পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মুস্তাক আহমেদ দৈনিক কালের সমাজকে বলেন, সমিতির অন্য সদস্যরা ৬০ ভাগ ঋণ পরিশোধ না করায় আমাকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। অথচ আমি এই ঋণ পাওয়া যোগ্য। তাঁতের সুতা, শ্রমিকদের মজুরি ও রঙ কেনায় অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। এসবের যোগান দিতে আমায় বাধ্য হয়ে চড়া সুদে দাদন নিতে হচ্ছে।
বেলকুচি পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতির সভাপতি ইমরাম হোসেন দৈনিক কালের সমাজকে বলেন, তাঁতিদের এখন খুবই দুঃসময় চলছে৷ এ কারণে অনেক তাঁতির ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। আমার সমিতির ৪৫ জন সদস্য প্রায় এক কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। কিন্তু পরিশোধ করেছে মাত্র ৬ জন সদস্য। বাকি ৩৯ জন সদস্য ঋণ পরিশোধ না করায় নতুন ঋণের আবেদন করা যাচ্ছে না ৷
একই পৌরসভার ৮নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতির সভাপতি আব্দুল কাদের দৈনিক কালের সমাজকে বলেন, সমিতির বেশির ভাগ সদস্যরা ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। অনেকেই আবার ঋণগ্রস্ত হয়ে দাদন ব্যবসায়ীদের সুদের জালে পড়ে তাঁত বিক্রি করেছেন। এসব কারণে অন্য সদস্যরা আর ঋণ পাচ্ছে না। তবে এই ঋণ সব তাঁতির ভাগ্যে জোটে না৷
বাংলাদেশ জাতীয় তাঁতি সমিতির সভাপতি আব্দুস ছামাদ খান দৈনিক কালের সমাজকে বলেন, তাঁত শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে প্রত্যেক সদস্যকে নিয়মিতভাবে ঋণ দেওয়া প্রয়োজন। সমিতির কিছু সদস্যের কারণে অন্য সদস্যরা ঋণ পাবে না। এটা এক ধরনের বৈষম্য। তাঁত বোর্ডের এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা প্রয়োজন বলে মনে করি।
বেলকুচি বেসিক সেন্টারের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা তন্বী দৈনিক কালের সমাজকে বলেন, তাঁত শিল্পকে টিকিয়ে রাখা ও শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করাই মূল উদ্দেশ্য। এ জন্য তাঁত বোর্ড ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির আওতায় এই ঋণ প্রদান করে৷ বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৯ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। আমি ছাড়াও চারজন সুপার এগুলো আদায়ের চেষ্টা করছি। জুনের শেষ সপ্তাহে তাদের নোটিশও করা হয়েছে।
কালের সমাজ//র.ন
আপনার মতামত লিখুন :