তখন কোথায় ছিলো জাতিসংঘ? এখন কেন এতো দরদ উথলে ওঠলো? পিলখানা হত্যা ট্রাজেডি, শাপলা চত্বরের গনহত্যা ট্রাজেডির সময় এমন মানবিকতা কোথায় ছিলো? হেফাজতের আন্দোলনে রক্তের নদী বয়ে গেল জাতিসংঘ কিছু বলেছিল? প্রায় দেড়যুগকাল খুন, গুম, হত্যাসহ ভোটাধিকার হরণ করে ফ্যাসিস্ট সরকার জুলুমের সবটুকু করেছে এ দেশে, তখন এই জাতিসংঘ কী পৃথিবীর মানচিত্রে ছিল? চব্বিশে এক সাগর রক্ত ঝরলো, ২হাজার মানুষকে হত্যা করা হলো ছাত্র জনতার আন্দোলনে তখন কী এই জাতিসংঘকে পাশে পেয়েছিলাম? কিছু বলছিলো কি হাসিনা সরকারকে? জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এই দেশে কি বিদেশি রেসিডেন্সিয়ালের প্রয়োজন আছে? মানবিকভাবে রাষ্ট্রীয় কোনো সমস্যার সম্মুখিন কী আমরা? তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন ড. ইউনুস সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ কীসের অনুমোদন দিচ্ছে? আমরা কী বৃটিশদের গোলামির দিকে ফের ধাবিত হচ্ছি!
ঢাকায় জাতিসংঘের মানবিক কার্যালয় স্থাপনকে নব্যরূপে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন হিসেবে দেখছেন দেশের বোদ্ধামহল। এতে দেশপ্রেমিক নাগরিকরা মনে করছেন শঙ্কায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব!
ড. ইউনুস সরকার কী চিন্তা করছেন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে? আসলে কোন পথে যাচ্ছে বাংলাদেশ? ইসলাম এবং মুসলমানদের ঐতিহ্য কি তবে শুভঙ্করের ফাঁদে পা দিচ্ছে? আদৌ কী বাংলাদেশে এই মুহুর্তে জাতিসংঘের মানবিক কার্যালয় স্থাপন করা খুউব জরুরি? “ঢাকায় জাতিসংঘের মানবিক কার্যালয় স্থাপন” এক গভীর ও সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র মনে হচ্ছে। এটাকে ‘নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র আগমনী বার্তা ভাবা হচ্ছে!
ঔপনিবেশিক ইতিহাস বলছে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম এসেছিল বাণিজ্যের ছদ্মবেশে উপমহাদেশে। এরপর একে একে দখল করেছিল শাসন, সংস্কৃতি, শিক্ষা, আইন, এমনকি মানুষের চিন্তাভাবনা পর্যন্ত। আজকের জাতিসংঘ বা পশ্চিমা দাতাদের কথিত সহায়তাও যেন ক্রমশ সেই পথেই অগ্রসরমান— ধর্ম-সংস্কৃতি বিমুখ এক ‘সুশাসন’ কায়েমের নামে মুসলিম রাষ্ট্রব্যবস্থাকে করে তুলছে নিরীহ, নীতিহীন ও ভঙ্গুর।
জাতিসংঘ কার্যালয়ের নামে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক শক্তির দেহসর্বস্ব ছায়া বসানো হচ্ছে, যাদের লক্ষ্য শান্তি নয়, বরং ভৌগোলিক রাজনীতি, সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ ও ‘মানবাধিকার’ নামে ধর্মীয় চেতনাবিরোধী আদর্শ চাপিয়ে দেওয়া। এরমধ্যে এই কার্যালয় পরিচালনায় সমকামী লোক আবাসিক হচ্ছে এই দেশে! মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে এসব প্রতিষ্ঠানের নানাবিধ প্রকল্প প্রশ্ন তোলে- (১) ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা কি তবে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডে ‘ব্যাকডেটেড’? (২) নারী স্বাধীনতার নামে কি পরিবার ও পর্দার শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলা হচ্ছে? (৩) সুশীল সমাজ ও এনজিওদের ছত্রছায়ায় মুসলিম ঐতিহ্য কি তবে ধ্বংসের পথে? (৪) স্বাধীন বাংলাদেশের ভাষা সংস্কৃতি সমাজব্যবস্থা এবং সার্বভৌমত্ব কী ঠিকে থাকবে স্বমহিমায়? এরচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের পথচলা কোন দিকে? কোন পথে বাংলাদেশের ভবিষ্যত? একদিকে পশ্চিমা মোড়কে গড়া রাষ্ট্রীয় কাঠামো, অন্যদিকে মসজিদ-মাদরাসাকেন্দ্রিক মুসলিম চেতনা—এই দ্বৈরথে যদি রাষ্ট্র অচেতন হয়, তবে ইতিহাস ফিরে আসবে নব্য উপনিবেশিক চেহারায়। দেশের সার্বভৌমত্ব তখন শুধু কাগজে থাকবে, বাস্তবে সব হবে নির্দেশিত, বিদেশি দাতাগোষ্ঠী আর কূটনীতিকদের মর্জিমাফিক।
যদি আমরা কেবল উন্নয়নের নামে আত্মার মূল্যায়ন হারাই! যদি আমরা আসল পরিচয় বিসর্জন দিয়ে বিশ্বনাগরিক হই! যদি ইসলামের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে কেবল রাষ্ট্রকে মডার্ন বানাতে চাই! তবে হ্যাঁ, ঐতিহ্য শুধু যাদুঘরে থাকবে। পাঞ্জাবি-টুপি থাকবে মঞ্চে, বাস্তবে থাকবে পোশাকের নামে ভিন্ন এক সভ্যতার দাসত্ব। ত্মপরিচয়ের জাগরণ আর ঘটবে না। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে ধর্মীয় বোধের স্থান হবে না। বিদেশি প্রভাবের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ও জনগণের ইসলামপ্রীতি ও বিশ্বাসকে রাষ্ট্রীয় নীতিতে চালাতে হব।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি দল সর্বপ্রথম ১৬১৩ সালে মুঘল রাজদরবারে ব্যবসা করার জন্য অনুমতি দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করেন। তখন মুঘল সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা ছিল বাণিজ্য কুঠি বা কারখানা ভিত্তিক। সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে তারা কুঠি নির্মাণ করার অনুমতিই চেয়েছিলেন মাত্র। পরবর্তীতে সম্রাট জাহাঙ্গীরের অনুমতিতে ইস্ট কোম্পানি অধুনা গুজরাটের সুরাটে তাদের প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করেন।
যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে ইংরেজগণ শতাধিক বৎসরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সাধ্য সাধনার ব্যবসায়ী থেকে শাসকে পরিণত হয়েছিল, সাড়ে পাঁচশত বৎসরব্যাপী প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসনের মূলোৎপাটন করে ভারতবর্ষকেই এ দেশবাসী০ো গোলামীর শৃখলে আবদ্ধ করেছিল, তাদের এ দেশে আগমন ও পরবর্তী কার্যকলাপ আমাদের ভালো করে জেনে রাখা দরকার। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কেবল ভূখণ্ড নয়, এটি একটি বিশ্বাসের ঠিকানা। এখানে বিশ্বাস হারালে, সবই হারিয়ে যাবে।
যেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছদ্মবেশী আগমন ঘটেছিল একটি ব্যবসায়ী সংগঠন হিসেবে, তারা শতাধিক বছরের চতুরতা, ধূর্ততা ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উপমহাদেশের বুকে শক্ত শিকড় গেড়ে শাসকে পরিণত হয়। তারা ব্যবসার নামে এসেছিল, কিন্তু কৌশলে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল। তারা বানিজ্যের ফাঁদ পেতেছিল, কিন্তু সেই ফাঁদেই একে একে ধরা পড়েছিল বাংলার নবাব, দিল্লির বাদশাহ, উপমহাদেশের স্বাধীনতা। মুঘলআমলের সাড়ে পাঁচ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এ ভূখণ্ডে যে মুসলিম শাসনব্যবস্থা ছিল—যেখানে ধর্ম, ন্যায়, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল একটি আলোকোজ্জ্বল সমাজব্যবস্থা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তারই মূল উৎখাত করে দেয়। তারা কেবল মসনদ দখল করেনি, তারা মননেও দখল চেয়েছে। তারা কেবল রাজ্য ছিনতাই করেনি, তারা চেয়েছে বিশ্বাসের শেকড় উপড়ে ফেলতে।
এই ইতিহাস আমাদের জানতে হবে, বুঝতে হবে, এবং ভবিষ্যতের জন্য তা সংরক্ষণ করতে হবে। কারণ, বাংলাদেশ কেবল একটি ভূখণ্ড নয়। এটি একটি বিশ্বাসের ঠিকানা, একটি আদর্শের প্রতীক। এখানে বিশ্বাস হারানো মানেই আত্মপরিচয় হারানো। বিশ্বাস নষ্ট হলে স্বাধীনতার রূপ থাকে, কিন্তু প্রাণ থাকে না। এই বাংলাদেশ যদি ঈমানের শক্তি হারায়, তবে শুধুই ভূগোল বাঁচে, আত্মা নয়। তাই, ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে জাতিকে জাগ্রত করতে হবে। আমেরিকা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমাদের পূর্বসূরিরা যেমন দাঁড়িয়েছিলেন, আমরাও তেমনভাবে দাঁড়াতে পারি, কেবল শর্ত একটাই: আমরা যেন আমাদের বিশ্বাসকে অক্ষুন্ন রাখতে পারি।
কলের সমাজ/এ.জে
আপনার মতামত লিখুন :