ঢাকা রবিবার, ২০ জুলাই, ২০২৫, ৪ শ্রাবণ ১৪৩২

ডেথ ভ্যালি : মৃত্যু উপত্যকা বাংলাদেশ

কালের সমাজ | মো. কামরুল কাউসার খান জুলাই ১৯, ২০২৫, ০৮:৩৫ পিএম ডেথ ভ্যালি : মৃত্যু উপত্যকা বাংলাদেশ

প্রতিদিন সকাল মানেই এখন আতঙ্ক। পত্রিকার শিরোনামে চোখ রাখলেই ভেসে আসে মৃত্যুর পরিসংখ্যান-কখনো রাজনৈতিক সহিংসতায়, কখনো সড়ক দুর্ঘটনায়, আবার কখনো এক মশার কামড়ে। মৃত্যু যেন আমাদের ঘরের চেনা অতিথি হয়ে উঠেছে। একসময় যা ব্যতিক্রম ছিল, এখন তা নিয়মিত; যা ছিল অপ্রত্যাশিত, এখন তা অদ্ভুত এক স্বাভাবিকতা। আজকের বাংলাদেশ এক ভয়ংকর রূপকথার নাম-যেখানে মানুষের জীবনের মূল্য পদে পদে অবহেলিত, আর রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক দলের কাঠামো যেন এক নির্বিকার দর্শক।

 

এই মৃত্যু শুধু সংখ্যার খেলা নয়। প্রতিটি প্রাণহানি একটি পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ, একটি শিশুর অনাথ হয়ে যাওয়া, একজন মায়ের বুকফাটা আহাজারি। আর তাই এই লেখা নিছক সমালোচনা নয়, এটি এক অন্তরালে জমে থাকা ক্রন্দনের প্রতিধ্বনি।

১.স্বাধীনতার পর অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের রাজনীতি যেন এখনও সহিংসতার কাঁটাবনে আটকে আছে। বিগত ১৫ বছরে রাষ্ট্রের সহায়তায় যে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ক্রমবর্ধমান ধারা তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে গত এক বছরে তা এক ভয়ংকর মাত্রায় পৌঁছেছে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে শুধুমাত্র ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সময়েই রাজনৈতিক অস্তিরতায় প্রায় দুই হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এ সংখ্যা কেবল পরিসংখ্যান নয়-প্রতিটি নামের পেছনে আছে অসংখ্য স্বপ্নভঙ্গ, যন্ত্রণাক্লিষ্ট পরিবার, এবং আর্তনাদমুখর ভবিষ্যৎ।
রাজনৈতিক দলগুলোর এমন বেপরোয়া কার্যক্রমে জিম্মি হয়ে আছে সাধারন মানুষ।বাচাঁর আর্তনাদে জেগে উঠতে চায় আত্মচিৎকারে।

রাজনীতির উদ্দেশ্য যেখানে জনগণের সেবা, সেখানে তা হয়ে উঠেছে দমন-পীড়নের হাতিয়ার। বিরোধী মতকে নিশ্চিহ্ন করতে গিয়ে প্রতিটা দলই, গণতন্ত্রের কবর রচনা করছে। ক্ষমতারমোহ অন্ধ করেছে শাসন ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে থাকা দায়িত্বশীলদের,জবাবদিহিতার অভাব, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং রাজনীতিকে ব্যবসা ও পেশায় রূপান্তরের এই সংস্কৃতি একটি ভয়ংকর সমাজ গঠনের পথ উন্মুক্ত করেছে-যেখানে মতপ্রকাশ মানে মৃত্যুঝুঁকি, এবং সক্রিয় নাগরিক মানে রাষ্ট্রশক্তির বা ক্ষমতাশীলদের চক্ষুশূল।

এই ধারাবাহিক সহিংসতা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিনিয়োগ কমছে, পর্যটন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক ঘৃণার আখড়ায় পরিণত হচ্ছে। রাজনীতির নামে এই যে মৃত্যুর উৎসব, এটি বন্ধ না হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে-একটি রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়বে।

২.যে রাস্তায় মানুষ জীবনের গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়, সেই রাস্তাই এখন মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছেন। এই পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে ভয়াবহ অব্যবস্থা-অদক্ষ ও অশিক্ষিত চালক, ঘুষের বিনিময়ে দেওয়া লাইসেন্স, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রাফিক প্রশাসন এবং অনিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থাপনা।

সড়কে চলা যেন প্রতিনিয়ত জীবন বাজি রেখে যাত্রা করার নাম। চালকদের কাছে গতি নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং ‘কে আগে পৌঁছাবে’ সেই প্রতিযোগিতা মুখ্য। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা কমিশনভিত্তিক নিয়োজিত, মালিকের চাপ, আয় না হলে চাকরি যাবে-এই চক্র তাদের অমানবিক করে তুলেছে। ফলাফল: পথচারী, যাত্রী, স্কুলগামী শিশু কিংবা বৃদ্ধ-সবাই এই অসতর্ক চালনার বলি হচ্ছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মানুষজন কেবল ব্যক্তি নয়, বরং একটি সমাজের ভবিষ্যৎ। একজন শিক্ষার্থী, একজন শ্রমিক, একজন শিক্ষক কিংবা একজন চিকিৎসকের মৃত্যু মানে দেশের মানবসম্পদ হারিয়ে যাওয়া। আর এই মৃত্যুগুলোর প্রতিরোধে নেই কার্যকর উদ্যোগ। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন থেকে শুরু করে নানা আশ্বাস পাওয়া গেলেও বাস্তবে পরিবর্তনের কোনো চিহ্ন নেই।

প্রশাসনের উদাসীনতা এবং দুর্নীতির বলয়ে ঘেরা ট্রান্সপোর্ট সেক্টর আমাদের প্রতিদিন মৃত্যুর মুখোমুখি করছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিষ্ক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় পরিবহন মালিকদের দাপট এই সমস্যা আরও জটিল করে তুলেছে।

৩.প্রতিবছর বর্ষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু বাংলাদেশে এক ভয়ংকর মহামারির রূপ নেয়। অথচ এই ভাইরাসের বিস্তার রোধে কার্যকর কোনো দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা দেখা যায় না। ২০২৩ এবং ২০২৪ সালের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ থাকলেও, ২০২৫ সালেও ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে।

জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার এই ব্যর্থতার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, দুর্নীতি, এবং অদক্ষতা। প্রয়োজনীয় ওষুধ, পরীক্ষা কিটের অপ্রতুলতা, হাসপাতালের বেড সংকট, এবং চিকিৎসক ও নার্সদের অভাব এই রোগ মোকাবিলাকে কঠিন করে তুলেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো-ডেঙ্গুতে যারা প্রাণ হারাচ্ছেন, তাদের বড় অংশই মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ, যারা প্রাইভেট হাসপাতালের খরচ বহন করতে পারে না, আবার সরকারি ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত সেবা পান না।

শুধু যে ডেঙ্গু, তা নয়-বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রেও প্রায় একই রকম। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও বাজেট অপচয়ের ফলে কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও সাধারণ মানুষের কাছে তা পৌঁছায় না। স্বাস্থ্যকে ‘সেবা’ নয়, বরং এক ধরনের ‘সেবা ব্যবসা’ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। যার ফলাফল-প্রতি বর্ষায় ডেঙ্গুর মতো প্রতিরোধযোগ্য রোগেও অসংখ্য মৃত্যু।

এই রাষ্ট্র কার?

রাজনীতি, সড়ক এবং স্বাস্থ্য-এই তিনটি জায়গায় প্রতিনিয়ত যেভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে, তা রাষ্ট্র ব্যবস্থার গলায় এক অমোচনীয় কলঙ্ক। যে রাষ্ট্র নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে পারে না, তার উন্নয়ন ও অগ্রগতির দাবি কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে?

আজ বাংলাদেশে একটি বিশাল অংশের মানুষের মনে একটাই প্রশ্ন-এই রাষ্ট্র আসলে কার জন্য? সাধারণ মানুষের জন্য, নাকি কিছু সুবিধাভোগী ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর জন্য? যে রাষ্ট্রে প্রতিদিন মানুষের মৃত্যু ঘটে অবহেলায়, অব্যবস্থাপনায় ও দুর্নীতিতে-সে রাষ্ট্র কি আদৌ গণতান্ত্রিক বা মানবিক হতে পারে?

আমরা দেখতে পাই, বাজেট পাস হয় হাজার হাজার কোটি টাকার, উন্নয়নের বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হয়, মেগা স্ট্রাকচার দাঁড়িয়ে যায়—কিন্তু একটি সাধারণ নাগরিক সড়কে, হাসপাতালে, কিংবা রাজপথে নিরাপদ নয়। জীবন এখানে সবচেয়ে সস্তা, আর উন্নয়ন কেবল পরিসংখ্যানের খেলায় সীমাবদ্ধ।


মৃত্যুর উপত্যকা থেকে জীবনের পথে-
বাংলাদেশ আজ যেন মৃত্যু উপত্যকার আরেক নাম। প্রতিদিন গড়ে অসংখ্য প্রাণ হারানো, রাষ্ট্রের নীরবতা, এবং নাগরিকের অসহায়ত্ব-এই চিত্র আমাদের আত্মপরিচয়ের সংকটে ফেলছে। কিন্তু এই পরিণতি অনিবার্য নয়। আমাদের সামনে এখনো আছে পরিবর্তনের সুযোগ।

প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, জবাবদিহিতা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং নাগরিক জীবনের মর্যাদাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। উন্নয়নের নামে গল্ড প্লেটেড প্রকল্প নয়-মানুষের জীবনের জন্য প্রয়োজন কার্যকর ব্যবস্থা, ন্যায়বিচার, এবং মানবিক রাষ্ট্রচিন্তা।

একটি জীবনের মূল্য যদি রাষ্ট্র বুঝতে শেখে, তবেই বাংলাদেশ আবার পরিণত হতে পারে আশার প্রতীক, মরুভূমিতে জীবনের ঝরনাধারা। রাষ্ট্রের কাছে একটাই প্রত্যাশা-মৃত্যু নয়, জীবন হোক বাংলাদেশের মুখচ্ছবি।

 

লেখক : কবি
 

কালের সমাজ/হাকা

 

Side banner
Link copied!