জুম চাষ পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এক প্রাচীন কৃষি পদ্ধতি। এটি কেবল খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যম নয়, বরং পাহাড়িদের আত্মপরিচয়, ঐতিহ্য এবং স্বনির্ভরতার প্রতীক।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বাপ-দাদার সময় থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসা এই চাষাবাদে প্রকৃতিই হলো মূল ভরসা। ঢালু পাহাড়ি জমিতে গাছপালা পোড়ানোর পর বীজ ছিটিয়ে দিয়ে বৃষ্টির পানির উপর নির্ভর করে ফসল ফলানো হয়। একসময় বান্দরবানসহ পার্বত্য জেলাগুলোতে প্রায় ৯৫ শতাংশ পাহাড়ি পরিবার জীবিকার জন্য জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল ছিল। যদিও শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির প্রসারে জুম এখন বিলীনপ্রায়, তবুও দূরবর্তী দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে আজও এর অস্তিত্ব টিকে আছে।
আগে যেখানে বিশাল জুম ক্ষেত দেখা যেত, এখন সেখানে ক্ষুদ্র পরিসরে আড়ি কিংবা আধা আড়ি জমিতে চাষ হয়। অনেক ক্ষেত্রে এর উদ্দেশ্য থাকে ঐতিহ্যকে ধরে রাখা। তবে জুম কেবল ধান উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ নয়, একে পাহাড়িরা বলেন “জুম মানেই এক বাজার।” কারণ, একসাথে ৩০ থেকে ৩৫ প্রকার সাথী ফসল উৎপাদন হয় এতে। ধানের পাশাপাশি জন্মায় তিল, কাকন, যব, মারফা, বেগুন, মরিচ, ঠান্ডা আলু, ঢেঁড়স, তুলা প্রভৃতি। ফলে বাজার থেকে কেবল লবণ আর চিদোল নাপ্পি কিনলেই চলে।
জুমকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনও। ফসল রোপণ, পরিচর্যা, ধান কাটা কিংবা নতুন ধানের নবান্ন উৎসব—প্রতিটি ধাপই রঙিন হয়ে ওঠে গান, নৃত্য ও সমবেত শ্রমের ঐতিহ্যে।
যদিও পরিবর্তনের স্রোতে জুম চাষ দিন দিন প্রান্তিক হয়ে পড়ছে, তবুও পাহাড়িদের কাছে এটি শুধু একটি কৃষি ব্যবস্থা নয়; বরং তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আত্মমর্যাদার প্রতিচ্ছবি। জুম আজও পাহাড়ি মানুষের স্বনির্ভরতা ও প্রকৃতিনির্ভর জীবনের প্রাণস্পন্দন হয়ে বেঁচে আছে।
কালের সমাজ//র.ন
আপনার মতামত লিখুন :