ঢাকা শুক্রবার, ০১ আগস্ট, ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২

সিরাজগঞ্জের সাবেক এমপি জান্নাত আরা হেনরির সম্পদের রহস্য -শূন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক

কালের সমাজ | জলিলুর রহমান জনি, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জুলাই ৩১, ২০২৫, ১১:৪১ এএম সিরাজগঞ্জের সাবেক এমপি জান্নাত আরা হেনরির সম্পদের রহস্য -শূন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক

স্কুল শিক্ষিকা থেকে সম্পদের পাহাড় করেছেন সাবেক এমপি জান্নাত আরা হেনরির - মাত্র ১৪ বছরে বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছেন, যা নিয়ে চলছে আলোচনা।জান্নাত আরা হেনরি, একজন প্রাক্তন স্কুল শিক্ষিকা, যিনি আওয়ামী লীগের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন। টাকা, গাড়ি, বাড়ি আর সম্পদের পাহাড় যেন কাল্পনিক গল্প কেউ হার মানায়।

তার সম্পদের এই অভূতপূর্ব বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক উত্থান অনেকের মনে কৌতূহল জাগিয়েছে। মাত্র ১৪ বছরের মধ্যে, তিনি মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সাধারণ সহকারী শিক্ষক থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে উঠেছেন।

জান্নাত আরার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় সিরাজগঞ্জ সদরের সবুজ কানন উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে। এরপর আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনকালে তিনি রাজনৈতিক জগতে প্রবেশ করেন এবং এমপি হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু তার এই উত্থান ও সম্পদ সংগ্রহের পেছনে রয়েছে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক।তার সম্পদের পাহাড় নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, তার সম্পদের বেশিরভাগই বেআইনিভাবে অর্জিত। সাধারণ একটি ঘর থেকে রাজপ্রাসাদের মতো জীবনযাপন শুরু করেন তিনি।জান্নাত আরার সংসদ সদস্য হিসেবে মেয়াদ ছিল মাত্র ৬ মাস ২৫ দিন। কিন্তু তার এই স্বল্প সময়ের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারেও তিনি বিশাল সম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠেন। তার এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উত্থানের পেছনে কীভাবে এত দ্রুত সম্পদ সংগ্রহ করা সম্ভব হলো তা নিয়ে চলছে তদন্ত।

সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক করা হয়। এরপর থেকে তার রোজগারের মেশিন যেন কয়েকশ’ গুণ গতি পায়। হলমার্ক কেলেঙ্কারির সুবিধাভোগী, ঋণ প্রদান, পদোন্নতির তদবির পূরণসহ তৎকালীন আওয়ামী সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে তদবির বাণিজ্যে দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন হেনরি। বিভিন্নভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়ে টাকার কুমিরে পরিণত হন রাতারাতি।

দুদক আদালতকে জানিয়েছে, ‘দুর্নীতি ও ঘুষ’ সংঘটনের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ ও অবৈধ অর্জিত সম্পদ আড়াল করেছে হেনরি। তার ৩৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২ হাজার ২ কোটি ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭৭ টাকা এবং ১৩ কোটি ৭৮ লাখ ৪৬ হাজার মার্কিন ডলারের সন্দেহজনক লেনদেন করে মানিলন্ডারিং করেছেন। অধিকাংশ সম্পদের তথ্য আয়কর নথিতে উল্লেখ করেনি। ৫৭ কোটি ১৩ লাখ ৭ হাজার ২২৩ টাকা জ্ঞাত আয় উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জন করেছেন সাবেক এই এমপি।

হেনরির সম্পদের মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জ সদরে ৭ তলা ভবন, যার দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে ২ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সিরাজগঞ্জে ১টি ফ্ল্যাট, দলিলমূল্য ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ঢাকার মিরপুরে রজনীগন্ধা কমপ্লেক্সে ২টি ফ্ল্যাটের মূল্য ৫০ লাখ টাকা; সিরাজগঞ্জের বাহুকা রতনকান্দি এলাকায় ৪ হাজার বর্গফুটের ২ তলা ভবনের মূল্য ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা; সিরাজগঞ্জের ভূতেরদিয়া এলাকায় ০.০৬৩৭ শতাংশ জমিসহ ভবনের মূল্য (দলিল নং-৪৩৮০) ৮২ লাখ ১৪ হাজার টাকা; ভূতেরদিয়ায় ০.০৭০০ একর জমি (দলিল নং ৭৩০২) মূল্য ২ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার টাকা এবং নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কামতা মৌজার ১৭ নং সেক্টরের ৪০২ নং সড়কের ৮ নং প্লটের ৫ কাঠা জমির (দলিল নং-৪৫৩৬) মূল্য দেখিয়েছেন ২২ লাখ ২০ হাজার টাকা। একই সেক্টরের ৩০৫ নং সড়কের ৪ নং প্লটের ৪ কাঠা জমি (দলিল নং-৫৯৩৭) ক্রয় করেছেন ২২ লাখ ২০ হাজার দলিলমূল্য দেখিয়ে। পটুয়াখালির খেপুপাড়ায় ২.৫১ একর জমি কিনেছেন (দলিল নং-২৫৭৪) ১ কোটি ১০ লাখ ৯২ হাজার টাকায়।

সিরাজগঞ্জ সদরের বাহুকা-রতনকান্দি এলাকায় ১১টি পৃথক দলিলে (দলিল নং-৬৬৮৮, ৬৬৩৯, ৮২২, ৩৮৫৯, ৩৯৬৯, ৪৫৭৭, ৬১৮৫, ০৮০৮, ৩৮১০, ৩৯৫৬) সাড়ে ৩ একর জমি ক্রয় করেছেন। এসব সম্পদের দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে ৫৫ লাখ ৮২ হাজার টাকা। সিরাজগঞ্জের পূর্ব মোহনপুরে ০.৬১ একর জমি কিনেছেন (দলিল নং ৪৫৭৬ ও ৪৫৭৭) ১৯ লাখ ৮৬ হাজার ১৮০ টাকা মূল্যে। শিলন্দা ও বনবাড়ীয়ায় ৪.৬ একর জমি ক্রয় করেছেন (দলিল নং-১০৬১৩, ২৬৯৮, ২৬৯৯) ১ কোটি ৬ লাখ ৯০ হাজার ৫৫৬ টাকা দলিলমূল্যে। সদানন্দপুরে ৫টি পৃথক দলিলে ৪৫.১৫ শতাংশ জমি কিনেছেন ৭৮ লাখ ৮৮ হাজার ৪৯৩ টাকায়, যা আয়কর নথিতে প্রদর্শিত আছে।

এ ছাড়া সিরাজগঞ্জের ভারাঙ্গা এলাকায় ১২টি পৃথক দলিলে (দলিল নং-৯৬৯, ৯৬৭, ৯৬৮, ৯৭১, ১২৪৬, ১০১৮, ৩৯৫৬, ১১১৬, ১০১৫, ৯৭২, ১৮০৭) ৫ একর সম্পত্তি ক্রয় করেছেন ১ কোটি ১১ লাখ ৩৬ হাজার ৪০০ টাকা দলিলমূল্যে। রায়গঞ্জে ২.১৮ একর জমি (দলিল ৪৮৯৭) মূল্য ৩০ লাখ টাকা।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর জান্নাত আরা হেনরি ও তার স্বামী শামীম তালুকদার লাবু আত্মগোপনে চলে যান। তবে একই বছর ৩০ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার থেকে গ্রেফতার হন। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন। দুদক তাদের আরও সম্পদের উৎস তদন্ত করছে। সন্ধান পাওয়া এসব সম্পদ যেন হস্তান্তর বা স্থানান্তর করতে না পারে সেজন্য আদালতে রিসিভার নিয়োগের আবেদন জানালে আদালত তা মঞ্জুর করেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে এবং তাকে গ্রেফতার করেছে। তার বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়মের অভিযোগের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করেছে এবং তার বিরুদ্ধে মামলা চলছে।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের ঘটনা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ণ করতে পারে এবং সরকারের জন্যও এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সমাজের সাধারণ মানুষও এ ব্যাপারে সচেতন হচ্ছে এবং সঠিক বিচার আশা করছে।জান্নাত আরার এই সম্পদ সংগ্রহের পেছনে তার রাজনৈতিক প্রভাব কতটা ভূমিকা রেখেছে তা খতিয়ে দেখার জন্য তদন্ত চলছে।

এই ঘটনাটি কেবল জান্নাত আরার রাজনৈতিক ভবিষ্যতই নয়, বরং সামগ্রিকভাবে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের উপরও প্রভাব ফেলবে।

কালের সমাজ//র.ন

Side banner

পথে-প্রান্তরে বিভাগের আরো খবর

Link copied!