ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সন্দেহ-সংশয় যেন কাটছেই না। রাজনীতির ময়দানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন বৈঠক এ সন্দেহ-সংশয় অনেকটা দূর করে দিলেও এখন পর্যন্ত পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না যে, আগামী ফেব্রুয়ারি তথা ২০২৬ সালের রমজানের আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। লন্ডন বৈঠকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তাতে আবারও সংশয় দেখা দিয়েছে। মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ড এবং গোপালগঞ্জের ঘটনাসহ সারাদেশে মবোক্র্যাসি, হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বলেছেন, লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের আশ্বাসের পর থেকেই চক্রান্তকারীরা ঝামেলা শুরু করে দিয়েছে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘উত্তেজিত হবেন না, বিভ্রান্ত হয়ে তাদের পাতা ফাঁদে পা দেবেন না।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দেশ ফ্যাসিস্ট মুক্ত হলেও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। দেশ ফ্যাসিস্ট মুক্ত হওয়ার মাধ্যমে নতুন একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে এই গণতন্ত্রে যেন উত্তরণ না ঘটে তার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, নেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে। এমনকি আমার নেতা তারেক রহমান সম্পর্কে অশ্লীল অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলা হচ্ছে। এটা কেন করা হচ্ছে? ভয় পেয়ে, তারা ভয় পেয়েছে। তারেক রহমান তো জাতীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন। এখন তিনি যদি ফিরে আসেন তাহলে তারা যাবে কোথায়? আমি এটুকু আশ্বাস দিতে পারি, তারা সঠিক জায়গায় থাকবে। তাই আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি।’ মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। আমরা আগেই উপলব্ধি করেছিলাম তৎকালীন সরকার দেশকে যেখানে নিয়ে গেছে, সেখান থেকে উত্তরণ প্রয়োজন ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে বিএনপির মতো এত ত্যাগ কেউ স্বীকার করেছে কি না, তা জানা নেই। আমাদের ২০ হাজার নেতা-কর্মীকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এতকিছুর পরও বিএনপি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এই দেশে যা কিছু মহান অর্জন হয়েছে বিএনপির হাতে। ১৯৭১ সালে যে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল; বাংলাদেশের যে স্বাধীনতার ঘোষণা, সেই ঘোষণা দিয়েছিলেন আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বেগম খালেদা জিয়া সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে এসেছেন, তিনি আমাদের অনেক আপত্তি থাকা সত্ত্বেও জনগণের চাওয়ার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান চালু করেছিলেন।’ ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘লন্ডনে তারেক রহমান ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর ষড়যন্ত্র শুরু হলো, নির্বাচন হতে দেওয়া যাবে না।
এ দেশের মানুষ সংগ্রাম-লড়াই করেছে, তারা তাদের যে দাবি (নির্বাচন) সেটি আদায় করে নেবে এবং এই নির্বাচন অবশ্যই ফেব্রুয়ারি মাসের যে ঘোষিত সময় সেই সময়ের মধ্যে নিশ্চয়ই অনুষ্ঠিত হবে।’
পাতানো ফাঁদে নেতা-কর্মীদের পা না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রের শত্রু চতুর্দিকে; বিএনপি হচ্ছে ডেমোক্র্যাসি, ফ্রিডম এবং ডেভলপমেন্ট। এটি আমরাই করব, ভবিষ্যতে আমরাই বাংলাদেশকে একেবারে উন্নয়নের চরমে নিয়ে যাব। কাজেই এদের কোন পাতা ফাঁদে আমরা পা দেব না, এরা ফাঁদ পাতছে এবং আমাদের উসকানি দিচ্ছে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিবাদ করে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে এমন একটা অবস্থা তৈরি করি যেন গণতন্ত্রের উত্তরণটা ব্যাহত হয়। এই ফাঁদে আমরা পা দেব না।’
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব গণমাধ্যমে বিবৃতিও দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার দেওয়া বিবৃতিতে দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গণতন্ত্রে উত্তরণের পথকে বিঘ্নিত করতে এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বানচাল করতে একটি মহল পরিকল্পিতভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। মবোক্র্যাসি, হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর অযোগ্যতা এবং নির্লিপ্ততা পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা গণমাধ্যমে শুধু কথাই বলছেন, বাস্তবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। বুধবার রাতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ প্রকাশ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য অতিদ্রুত সব ব্যবস্থা নিতে সরকারকে আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া বৈঠকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ ঘিরে গোপালগঞ্জে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে বলা হয়, গোপালগঞ্জে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার ‘ব্যর্থ’ হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিবের পাশাপাশি দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুকসহ বেশ কজন সিনিয়র নেতা কয়েকটি অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, যত ষড়যন্ত্রই হোক না কেন জাতীয় নির্বাচন আর পেছানো যাবে না। নির্বাচন পেছানো হলে দেশের পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাবে। তিনি বলেন, পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। নির্বাচন বানচাল করতেই এই ষড়যন্ত্র। গোপালগঞ্জের ঘটনা প্রমাণ করে আওয়ামী লীগ এখনো পেশিশক্তির রাজনীতিতেই বিশ্বাস করে। জনগণের সমর্থন না নিয়ে ক্ষমতায় থাকার কারণে শেখ হাসিনা নিজেকে দানবে পরিণত করেছেন। মূলত জনগণের মাধ্যমে যে পরিবর্তন আসবে তা-ই টিকে থাকবে। বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
আপনার মতামত লিখুন :