ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর, ২০২৫, ২৩ আশ্বিন ১৪৩২

গাজা: ফিলিস্তিনের কান্না ও মুসলিম বিশ্বের নৈতিক দেউলিয়াত্ব

কালের সমাজ ডেস্ক | অক্টোবর ৭, ২০২৫, ১২:৩৪ পিএম গাজা: ফিলিস্তিনের কান্না ও মুসলিম বিশ্বের নৈতিক দেউলিয়াত্ব

একখণ্ড ছোট্ট ভূমি, অথচ ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক প্রান্তর, যেখানে প্রতিটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে ধ্বংসস্তূপের ভেতর, রক্তমাখা পাঁজরে শিশুদের কান্না আর লাশের গন্ধ নিয়ে।

মাত্র ৪১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য আর ১০ কিলোমিটার প্রস্থের এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে ২৩ লক্ষ মানুষের বসবাস; এটি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। চারপাশে ইসরায়েলি অবরোধ, ভূমধ্যসাগরের অগভীর তীর আর মিশরের সীমান্তে বন্ধ ফটক-গাজা যেন এক উন্মুক্ত কারাগার, যার প্রতিটি দিন বয়ে আনে ক্ষুধা, মৃত্যুভয় আর ভবিষ্যৎহীনতার অভিশাপ।

গাজার ইতিহাস রক্তে লেখা-ফারাওদের যুগ, আলেকজান্ডার, রোমান সাম্রাজ্য, ইসলামি খিলাফত, অটোমান শাসন, ব্রিটিশ উপনিবেশ, জাতিসংঘের প্রস্তাব এবং ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা-গাজার উপর দিয়ে বহু শক্তি হেঁটে গেছে, কিন্তু কেউই গাজাকে স্থিতিশীল থাকতে দেয়নি।১৯৪৮ সালের ‍‍`নাকবা‍‍` থেকে ১৯৬৭-এর দখল, এরপর হামাসের উত্থান থেকে আজকের গণহত্যা-গাজা যেন কেবল রাজনৈতিক ব্যর্থতার নয়, মানবতারও চরম ব্যর্থতার নির্লজ্জ স্মারক।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজার ৯০ শতাংশ মানুষ মানবিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানায়, ৬৩ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।একদিকে ইসরায়েলের বিমান হামলা, অন্যদিকে তীব্র ক্ষুধা-এই দুইয়ের মাঝে আটকে আছে একটি প্রজন্ম, যাদের স্বপ্ন দেখার অধিকারটুকুও নেই।শিশুরা স্কুলে নয়, যাচ্ছে হাসপাতালে বা কবরস্থানে; মায়েরা সন্তান হারিয়ে উন্মাদ, আর পুরুষেরা লড়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৫ হাজার ছাড়িয়েছে।এই সংখ্যা নিছক পরিসংখ্যান নয়-প্রতিটি সংখ্যা একেকটি কাটা হৃদয়, গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া শরীর, একেকটি শোকে পাথর হয়ে যাওয়া পরিবার। নিহতদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু।প্রতিটি বোমা ধ্বংস করছে শুধু ঘরবাড়ি নয়, গড়ে তোলা স্বপ্ন, সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং মনুষ্যত্বকেও।

আর এই বিভীষিকাময় বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে মুসলিম বিশ্ব যেন এক নিষ্ঠুর প্রহসনের নাট্যকার।

৫৭টি মুসলিম দেশের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া কেউই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইনের মতো ধনাঢ্য দেশগুলো-যাদের বার্ষিক রপ্তানি আয় ৮০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি-তারা চাইলে গাজার মানবিক পরিস্থিতি পাল্টে দিতে পারত।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, তারা ব্যস্ত ইউরোপীয় অতিথিদের সুরা পান করানো ও নৃত্যানুষ্ঠান আয়োজনে।

মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব আজ নারীলোলুপতা, বিলাসিতা আর ভোগবিলাসে নিমজ্জিত।

আল-আকসার ভূমি যখন আগুনে পুড়ছে, তখন এই নেতৃত্ব চুপচাপ চেয়ারে বসে তেলসম্পদের চুক্তি করছে পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে।

ওআইসি নামের অকার্যকর সংগঠন শুধু বিবৃতিতেই দায় সারে;আরব লীগ ততটাই নিষ্ক্রিয়, যতটা এক মৃতদেহ।ইসলামী ভ্রাতৃত্বের কথা যারা মুখে আউড়ে বেড়ায়, তারাই আজ গাজার রক্তপাতের সামনে বিবেকহীনভাবে নিশ্চুপ।শুধু কাতার ও তুরস্ক কিছু সীমিত সহায়তা পাঠিয়েছে-তাদের বাইরে আর কেউই সাহস দেখায়নি মানবিক সহায়তা পাঠাতে।আরব রাষ্ট্রগুলোর নির্লজ্জতা এমন চরমে পৌঁছেছে যে, আজও তারা ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেনি; বরং বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানে আরও আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়।কিছু সংহতির প্রস্তাব ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। প্রশ্ন হলো-বাস্তব পদক্ষেপ কোথায়?রাষ্ট্রীয়ভাবে খাদ্য, ওষুধ বা জরুরি সরঞ্জাম পাঠানোর কোনো দৃশ্যমান উদাহরণ নেই।পত্রিকা, সংবাদমাধ্যম কিংবা সরকারি ওয়েবসাইটে সত্যিকারের সাহায্য পাঠানোর কোনো প্রমাণ মেলে না।যখন দক্ষিণ আফ্রিকা, ভেনেজুয়েলা, কিউবা এমনকি কিছু লাতিন আমেরিকান দেশ গাজার জন্য ত্রাণ পাঠাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ শুধু দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে আত্মতুষ্টিতে ভোগে।এই দ্বিচারিতা জাতির আত্মপরিচয়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।

গাজা কেবল একটি ভূখণ্ডের নাম নয়-এটি এক জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম।গাজার প্রতিটি কণ্ঠস্বর একেকটি চিৎকার, যা মুসলিম বিশ্বের নিরবতা চুরমার করে দেয়।অথচ এই বিশ্ব আজ মেরুদণ্ডহীন, বিবেকহীন ও নেতৃত্বহীন এক প্রহসনের নামান্তর।তাদের রাজনৈতিক জড়তা, অর্থনৈতিক স্বার্থ আর ভোগবিলাসের মোহ একত্রে ফিলিস্তিনের লাশের পাহাড় গড়ে তুলেছে।তারা ভুলে গেছে-যে আগুন আজ গাজার বুকে জ্বলছে, তা কাল তাদের দরজায়ও কড়া নাড়বে।

ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।আজ যারা চুপচাপ, নির্লিপ্ত, ভীরু ও ভণ্ড, আগামী দিনের ইতিহাস তাদের নাম স্মরণ করবে ঘৃণার প্রতীক হিসেবে।আর যদি আমাদের এই নীরবতা এমনই থাকে, তবে গাজার ধ্বংসের দায় শুধু ইসরায়েলের নয়-এটি আমাদের, মুসলিম বিশ্বের, আমাদের আত্মমর্যাদাহীন নেতৃত্বের, আমাদের কৃতঘ্নতার প্রতিচ্ছবি।

গাজার কান্না শুধু রক্ত নয়-এটি একটি আয়না,যেখানে আমরা দেখতে পাই নিজেদের ভণ্ডামি, বিশ্বাসঘাতকতা, নিষ্ক্রিয়তা আর নৈতিক দেউলিয়াত্ব।এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যদি আমাদের বিবেক না জাগে-তবে বুঝে নিতে হবে,আমরাও সেই মৃতদের কাতারে পড়ে গেছি, যাদের দেহ বেঁচে থাকলেও আত্মা বহু আগেই মরে গেছে।
 

কালের সমাজ/ সাএ


 

Side banner
Link copied!