ঢাকা মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫, ১১ ভাদ্র ১৪৩২

পর্যটন: শুধুই ভ্রমণ নয়, এটি সংস্কৃতির সেতুবন্ধন

কালের সমাজ | হাফিজ রহমান আগস্ট ২৬, ২০২৫, ০৪:৩৪ পিএম পর্যটন: শুধুই ভ্রমণ নয়, এটি সংস্কৃতির সেতুবন্ধন

পর্যটন কেবল বিনোদন বা অবকাশ কাটানোর মাধ্যম নয়; এটি দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার একটি শক্তিশালী সেতুবন্ধন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করে মানুষ একে অপরের খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, লোকনৃত্য, সংগীত ও জীবনযাপন সম্পর্কে জানে। এই প্রক্রিয়ায় একটি প্রাকৃতিক সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটে, যা জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বোঝাপড়া ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে।

মানুষ জন্মগতভাবে নতুন জায়গা ঘুরে অজানাকে জানার প্রবৃত্তি রাখে। এই অদম্য ইচ্ছা, কৌতূহল ও বিনোদনের চাহিদার মিশ্রণেই আজকের পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে। তাই বলা যায়, পর্যটন শুধু ব্যক্তিগত আনন্দের খোরাক নয়; এটি সংস্কৃতির সেতুবন্ধন। সংস্কৃতি হলো একটি জাতির চিন্তা, কর্ম, আচরণ, বিশ্বাস এবং উৎসবের বহিঃপ্রকাশ।

বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনা

বাংলাদেশ একটি বিচিত্র সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের দেশ। বছরের প্রতিটি সময়ে দেশের বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠান পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। বিশেষ করে ঈদকালে মানুষের ভ্রমণ আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ঐতিহ্যগতভাবে ঈদের ছুটিতে মানুষ শহর থেকে গ্রামে এবং গ্রাম থেকে শহরে ছুটে যায়, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটায়। তবে বর্তমানে মানুষ বিদেশেও ভ্রমণের জন্য আগ্রহী হচ্ছে।

দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের মন জয় করে। সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, সেন্ট মার্টিন ও কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, হিমছড়ির ঝর্ণা, রামুর বৌদ্ধ মন্দির, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, হাতিয়ার ও নিঝুম দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওড়, টেকনাফ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়—এসব স্থানে পর্যটকরা এক অপরূপ সৌন্দর্যের সাক্ষী হন।

এছাড়া দেশের ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানও পর্যটনকে সমৃদ্ধ করেছে। লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, ষাটগম্বুজ মসজিদ, খাঁন জাহান আলীর মাজার, বরেন্দ্র জাদুঘর, লালন সাঁইয়ের মাজার এবং রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি—এসব স্থান দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির গর্ব। সিলেটের প্রাকৃতিক দৃশ্যও পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

পর্যটন: অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে অবদান

জাতিসংঘের বিশ্বপর্যটন সংস্থা (UNWTO)-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১৪০ কোটি। এই বিপুল সংখ্যার ৭৩ শতাংশ এশিয়ার দেশগুলোতে ভ্রমণ করে। বাংলাদেশেও দেশি ও বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটনের অবদান ২০১০ সালে ছিল মাত্র ১.৭ শতাংশ, যা বর্তমানে ৪.৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সরকারের লক্ষ্য ২০২৭ সালে এই হার ৭ শতাংশে পৌঁছানো। পর্যটন খাতে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ব্যাপক। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে এই শিল্প থেকে ২৯ কোটি ৭০ লাখ মানুষ কর্মসংস্থান পাবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে ১০.৫ শতাংশ অবদান রাখবে।

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ইতিহাস

পর্যটন খাতের গুরুত্বের ধারণা বাংলাদেশে শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকে। ১৯৯৯ সালে সরকার এটিকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর পর্যটন কর্পোরেশন ও ২০১০ সালে গঠিত ট্যুরিজম বোর্ডের মাধ্যমে শিল্পটি সমন্বিতভাবে এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

বর্তমানে দেশে প্রায় ৮০০টি পর্যটন স্থান চিহ্নিত রয়েছে। তবে যথাযথ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে এই শিল্প অনেকটা আড়ালে পড়ে আছে। আন্তর্জাতিক পর্যটন হাইলাইট করা প্রয়োজন, যাতে দেশের অপরূপ সৌন্দর্য দেশি-বিদেশী পর্যটককে আকৃষ্ট করে এবং অর্থনীতির পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়।

সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন

পর্যটনের বিকাশে সবচেয়ে বড় বাধা হলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় না হলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় লাগে। থাইল্যান্ডের মতো দেশে পর্যটন প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, ফলে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সম্ভব। বাংলাদেশেও এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে পর্যটন শিল্পের বিকাশ দ্রুত সম্ভব।

পর্যটনের উন্নয়নে প্রয়োজন পররাষ্ট্রনীতিমালা সহজীকরণ, ভিসা-জটিলতা দূরীকরণ, পর্যটন স্থানগুলোর সৃজনশীল প্রচারণা, পর্যটন বিশেষজ্ঞদের গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি। এছাড়া স্থানীয় মানুষকে পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা জরুরি। কমিউনিটি পার্টিসিপেশন নিশ্চিত হলে তারা পর্যটনকে নিজের শিল্প হিসেবে মান্য করবে এবং শিল্পের প্রকৃত বিকাশ হবে।

পর্যটন শিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য স্থির করেছে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন কার্যকর কর্মপরিকল্পনা, দীর্ঘমেয়াদী মাস্টারপ্ল্যান এবং বিভিন্ন পর্যায়ভিত্তিক উদ্যোগ।

বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্য, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য পর্যটককে আকৃষ্ট করে, যা দেশের অর্থনীতি, সামাজিক অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে আরও শক্তিশালী করবে। পর্যটন শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়; এটি দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও মানবসম্পদকে শক্তিশালী করার একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প।

লেখক: হাফিজ রহমান, বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক কালের সমাজ; অর্থ সম্পাদক, গ্লোবাল এভিয়েশন এন্ড ট্যুরিজম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন।

কালের সসমাজ//র.ন

Side banner

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের আরো খবর

Link copied!