বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৯,৮৪৭টি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রায় ৩,৯৮,০৬৮ জন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। তবে বিভিন্ন সূত্রে এই সংখ্যায় ভিন্নতা দেখা যায়-কিছু সূত্রে প্রতিষ্ঠান সংখ্যা ২২,১৭৪ বলা হয়েছে।
এই বিশাল শিক্ষা কাঠামোই দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের মূল ভিত্তি। কারণ, শিক্ষক জাতির নৈতিক ও বৌদ্ধিক মেরুদণ্ড-তিনি শুধু পাঠদান করেন না, আলোকিত চিন্তা শেখান, ন্যায়ের বোধ জাগিয়ে তোলেন, সমাজকে গড়ে তোলেন।
একটি জাতির উন্নয়ন, সংস্কৃতি ও মানবিক মান নির্ভর করে সে জাতি তার শিক্ষককে কতটা মর্যাদা দেয় তার ওপর। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো-যেখানে বিশ্বে শিক্ষক রাষ্ট্রীয় সম্মান ও নিরাপত্তার প্রতীক, সেখানে বাংলাদেশে আমরা দেখি শিক্ষকদের দাবি আদায়ের মিছিলে লাঠিচার্জ, জলকামান ও রক্তাক্ত রাস্তা।
এ এক ভয়াবহ বৈপরীত্য-বিশ্বে যেখানে শিক্ষক সম্মান পান, আমাদের দেশে তারা অপমানিত হন।
জাপানে শিক্ষকরা মন্ত্রীর সমান মর্যাদা ভোগ করেন। কোনো শিক্ষককে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনুমতি ছাড়া গ্রেপ্তার করা যায় না। সমাজে তারা নৈতিকতার প্রতীক, জাতির দিকনির্দেশক।
ফ্রান্সে শিক্ষককে বলা হয় “জাতির গর্ব।” আদালতে তারা বিশেষ আসনে বসেন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্মানিত হন, আর তাদের বেতন ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে।
চীনে শিক্ষকতা সবচেয়ে সম্মানিত পেশাগুলোর একটি। সেখানে প্রতি বছর পালিত হয় “Teacher’s Day”, শিক্ষার্থীরা কৃতজ্ঞতা জানায়-চীনা প্রবাদে বলা হয়, “একদিনের শিক্ষক, আজীবনের গুরু।”
দক্ষিণ কোরিয়ায় শিক্ষকরা সমাজে মন্ত্রী বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সমান মর্যাদা পান; অভিভাবক ও রাষ্ট্র উভয়েই তাদের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়।
ফিনল্যান্ডে শিক্ষকতা সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক ও মর্যাদাপূর্ণ পেশা-তারা ডাক্তার, প্রকৌশলী বা বিচারকের সমান সম্মান পান।
যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকরা “VIP স্ট্যাটাস”-এ থাকেন। পালিত হয় “Teacher Appreciation Week”, যেখানে সরকারি ও সামাজিকভাবে তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এই দেশগুলো বুঝেছে-শিক্ষক মানে ভবিষ্যৎ নির্মাতা, আর শিক্ষকের সম্মান মানেই জাতির সম্মান।বাংলাদেশে শিক্ষকতার পেশা কথায় সম্মানিত, কিন্তু বাস্তবে অবহেলিত।
যে পেশা দিয়ে জাতি গড়ে ওঠে, সেই পেশার মানুষরা আজ জীবিকার নিশ্চয়তা, সামাজিক নিরাপত্তা বা সম্মান-কোনোটিই পান না।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বছরের পর বছর ধরে বেতন কাঠামো, ভাতা ও মৌলিক সুবিধা বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করছেন। কিন্তু প্রশাসন ও নীতিনির্ধারকদের কাছে সেই দাবিগুলো যেন আজও তুচ্ছ।
তাদের সাম্প্রতিক তিন দফা দাবি ছিল মূল বেতনের ওপর ২০% বাড়িভাতা,চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি,উৎসবভাতার যথাযথ পুনর্বিন্যাস।এই দাবিগুলো কোনো বিলাসিতা নয়, বরং মৌলিক মানবিক চাহিদা। অথচ এই ন্যায্য দাবির জবাব এসেছে লাঠিচার্জ, সাউন্ড গ্রেনেড, জলকামান ও হাতকড়ায়।
২০২৫ সালের ১২–১৪ অক্টোবর, ঢাকার প্রেসক্লাব ও শাহবাগ এলাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো জাতীয় বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে।
পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হয়েছেন বহু শিক্ষক; কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়েছে।গণমাধ্যমে দেখা গেছে-বিক্ষোভরত শিক্ষক নেতাদের টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে; সামাজিক মাধ্যমে এমন ভিডিওও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে শিক্ষকদের হাতে হাতকড়া দেখা যায়।
একজন শিক্ষক, যিনি জাতির ভবিষ্যৎ গড়ে তোলেন, তাকে এভাবে অপমান করা কেবল মানবিক লঙ্ঘন নয়, রাষ্ট্রের নৈতিক অবক্ষয়ের চিহ্ন।
শিক্ষকরা কোনো রাজনৈতিক পক্ষ নয়; তারা ন্যায্য দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের উপর বলপ্রয়োগ মানে জনগণের বিবেকের উপর আঘাত। রাষ্ট্র যদি শিক্ষকের কণ্ঠরোধ করে, তবে সেটি গণতান্ত্রিক নয়-বরং নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার প্রতীক।
একটি সভ্য রাষ্ট্রে আন্দোলনের জবাব হয় সংলাপে, লাঠিতে নয়।
সরকারের উচিত অবিলম্বে শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে একটি বাস্তবায়নযোগ্য সময়সূচি ঘোষণা করা।পুলিশের আচরণের স্বাধীন তদন্ত করে দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।মিডিয়া ও নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব আছে-সত্যতা যাচাই ছাড়া কোনো তথ্য প্রচার না করা, এবং রাষ্ট্রের প্রতি মানবিক নীতি পালনের দাবি জানানো।
শিক্ষকের মর্যাদা কোনো দয়া নয়-এটি রাষ্ট্রের আত্মসম্মান।
যে দেশ তার শিক্ষককে রাস্তায় রক্তাক্ত করে, সেই দেশ একদিন তার ইতিহাসের কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়।আর যে দেশ তার শিক্ষককে সম্মান দেয়, তার ক্লাসরুম থেকে জন্ম নেয় আলোকিত প্রজন্ম, শক্তিশালী জাতি।
আজ প্রয়োজন সেই আত্মজিজ্ঞাসা-
আমরা কি সত্যিই শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করি, নাকি শুধু শিক্ষক দিবসে কিছু ফুল আর ভাষণেই তাদের ভূমিকা সীমাবদ্ধ রাখি?
শিক্ষকের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া মানে শুধু এক শ্রেণির দাবি মেটানো নয়-এটি জাতির আত্মাকে উদ্ধার করা।মাত্র এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া আর পাঁচশ টাকা চিকিৎসা ভাতা-তাও অধ্যক্ষ থেকে সুইপার পর্যন্ত একই,”
বিবিসি বাংলাকে এমনই বলছিলেন আন্দোলনরত এক শিক্ষক।
তিনি যোগ করেন, “সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যেখানে বেতনের চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িভাড়া পান, সেখানে আমরা পাই হাজার টাকার থোক বরাদ্দ।”
এই বক্তব্য একক শিক্ষকের নয়, বরং হাজারো শিক্ষকের আর্তনাদ।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা তিন দফা দাবিতে ক্লাস ছেড়ে রাজপথে নেমেছেন-রাজধানীতে টানা চতুর্থ দিনের মতো তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন।এর আগে, ‘মার্চ টু সচিবালয়’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে হাইকোর্ট মোড়ে পুলিশের ব্যারিকেডে বাধা পান তারা। সেখানেই শিক্ষক নেতারা আল্টিমেটাম দিয়ে বলেন-
“বুধবার বেলা ১১টার মধ্যে দাবি না মানা হলে শাহবাগে অবস্থান নেবো; দাবি না মানা হলে আমরণ অনশন।”আজ শহীদ মিনারে সকাল থেকেই শিক্ষকরা ব্যানার, ফেস্টুন হাতে জড়ো হচ্ছেন।স্লোগানে মুখর হচ্ছে এলাকা-“বেতন বৈষম্য দূর করো”, “শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা করো”।তারা বলছেন, “দীর্ঘদিন ধরে আমাদের ন্যায্য দাবি উপেক্ষিত। সরকার যদি আমাদের সহযোগিতাকে দুর্বলতা ভাবে, তবে আমরা দাবি আদায় ছাড়া রাজপথ ছাড়ব না।”
তাদের তিন দফা দাবি স্পষ্ট-মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া ভাতা, ১,৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা,কর্মচারীদের জন্য ৭৫ শতাংশ উৎসব ভাতা প্রদান।এই দাবিগুলো কেবল টাকার অঙ্ক নয়-এগুলো শিক্ষকদের অস্তিত্বের প্রশ্ন, মর্যাদার প্রশ্ন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রশ্ন।রাষ্ট্র যদি এই ন্যায্য দাবিগুলোকে উপেক্ষা করে, তবে তা কেবল শিক্ষকদের নয়, গোটা জাতির আত্মমর্যাদার প্রতি অবমাননা।
শিক্ষক শুধু একটি পেশার মানুষ নন-তিনি জাতির আত্মা, চিন্তার স্থপতি।একজন শিক্ষক রাস্তায় লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত হলে, আসলে আহত হয় একটি দেশের ভবিষ্যৎ।
এখন সময় এসেছে রাষ্ট্রের আত্মজিজ্ঞাসার-আমরা কি শিক্ষকদের সম্মান দেব, নাকি ইতিহাসে অপমানের দায় বয়ে বেড়াবো?
কালের সমাজ/ সাএ
আপনার মতামত লিখুন :