ঢাকা শুক্রবার, ১১ জুলাই, ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২

বরিশালে আতাহার উদ্দিন হাওলাদার ডিগ্রি কলেজে নকলের মহা উৎসব, সহযোগিতায় রয়েছেন শিক্ষকরা ‎

কালের সমাজ | গাজী আরিফুর রহমান, বরিশাল প্রতিনিধি জুলাই ১০, ২০২৫, ০৬:৪০ পিএম বরিশালে আতাহার উদ্দিন হাওলাদার ডিগ্রি কলেজে নকলের মহা উৎসব, সহযোগিতায় রয়েছেন শিক্ষকরা ‎

‎বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার আতাহার উদ্দিন হাওলাদার ডিগ্রি কলেজে এইচএসসি পরীক্ষার নামে প্রকাশ্যে নকল উৎসব চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। হলের মধ্যে বই এবং কাগজের টুকরো বের করে নকল করেছে পরীক্ষার্থীরা। আর এই নকল উৎসবে শিক্ষকরাই সহযোগিতা করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। 

‎‎স্থানীয়দের অভিযোগের পরিপেক্ষিতে বৃহস্পতিবার ( ১০ জুলাই ) সরজমিনে উপজেলার চরাদি ইউনিয়নের বলইকাঠী এলাকার আতাহার উদ্দিন হাওলাদার ডিগ্রি কলেজে উপস্থিত হয়ে মিলেছে অভিযোগের সত্যতা। এসব বিষয়ে কেন্দ্র সচিব মো. আকতার সাঈদ খানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি তার রুমের বাহিরে সাংবাদিকদের অপেক্ষা করতে বলেন। এবং সেই সুযোগে দায়িত্বরত অন্যন্যা শিক্ষকদের পরিক্ষার কেন্দ্রে পাঠিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। পরবর্তীতে প্রায় ৩০ মিনিট অপেক্ষা করার পরেও তার সাথে সাক্ষাৎ এর অনুমতি না পেলে সাংবাদিকরা বাকেরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুমানা আফরোজ (ইউএনও) কে ফোন করে বিষয়টি অবগত করেন। এর পর মো. আতাহার সাঈদ খান ইউএনও‍‍`র ফোন পেয়ে সাংবাদিকদের ভিতরে ডেকে নেন। 

‎‎জানা গেছে, উপজেলার আতাহার উদ্দিন হাওলাদার ডিগ্রি কলেজের কেন্দ্রে মোট ২৪০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে বৃহস্পতিবার বিজ্ঞান শাখায় ৭৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ৭৮ জন। ব্যবসায় শাখায় ৩৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ৩৩ জন এবং মানবিক শাখায় ৪৮ জনের মধ্যে সকলেই উপস্থিত ছিলেন। 

‎‎আতাহার উদ্দিন হাওলাদার ডিগ্রি কলেজের জেনারেল শাখার প্রিন্সিপাল জানান, পরিক্ষা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১০ জন শিক্ষক উপস্থিত আছেন।

‎এদের মধ্যে খান মো. আলী রেজা ও মনোজ কান্তি রায় নামক ২ জন আতাহার উদ্দিন হাওলাদার ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক ও বাকি ৮ জন শিক্ষক অন্যন্যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এসে দায়িত্ব পালন করছেন।  

‎‎কেন্দ্র সচিব মো.আকতার সাইদ খান সাংবাদিকদের তথ্য সরবরাহের জন্যে শিক্ষকদের রেজিস্টার খাতা বের করলে তাতে দেখা যায় দায়িত্বরত ১০ জন শিক্ষকের মধ্যে বাদলপাড়া স্কুল এন্ড কলেজ থেকে দায়িত্ব পালন করতে আসা শিক্ষক মো. আরিফুর রহমান বিশ্বাস রেজিস্টার খাতায় স্বাক্ষর না করেই পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করছেন। এরপর সাংবাদিকদের সামনেই রেজিস্টার খাতা কেন্দ্রে পাঠিয়ে তার কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে আসা হয়।

‎‎এদিকে পরীক্ষা কেন্দ্রের কেন্দ্র সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন একই কলেজের জেনারেল শাখার প্রিন্সিপাল মো. আকতার সাঈদ খান এবং হল সুপারের দায়িত্ব পালন করছেন একই কলেজের শিক্ষক মো.মনির হোসেন। এছাড়াও নিজ কলেজের আরও দুই শিক্ষক পরিক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করছেন। এতে পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে স্থানীয়দের মনে। 

‎‎স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলছেন, আতাহার উদ্দিন হাওলাদার ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীরাই পরীক্ষা দিচ্ছেন এই পরীক্ষা কেন্দ্রে। আবার তাদের কলেজের শিক্ষকরাই এখানে দায়িত্ব পালন করছেন পরিক্ষা নিয়ন্ত্রণের। মূলত শিক্ষকদের সহযোগিতায়ই শিক্ষার্থীরা নকলের সুযোগ পাচ্ছেন। তাছাড়া এই পরিক্ষা কেন্দ্রে প্রশাসনের কোন তদারকি নেই বললেই চলে। গত ২৬ জুন এইচএসসি পরিক্ষা শুরু হয়ে ইতিমধ্যে ৫ টি পরিক্ষা শেষ হয়ে গেছে। এর মধ্যে কোন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দেখা মেলেনি এই পরীক্ষা কেন্দ্রে। এই পরিক্ষা কেন্দ্রে নকল এখন ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে। 

‎‎নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পরীক্ষার্থী জানায়, কতিপয় পরীক্ষার্থী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নকল করে পরীক্ষা দিচ্ছে। কেউ বইয়ের পাতায় প্রশ্ন উত্তর ছিড়ে কেন্দ্রে নিয়ে আসছে, আবার কেউ কাগজের টুকরায় উত্তর লিখে এনে পরীক্ষা দিচ্ছে। আমাদের এখানের শিক্ষকরাই পরীক্ষার্থীদের নকলে সহযোগিতা করছেন। যে কারণে নকলসহ কেউ ধরা পড়ছে না। এতে আমরা মেধাবী শিক্ষার্থীরা চরম হতাশায় পড়েছি। শিক্ষার সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছেনা। পরিক্ষা শেষে ফলাফলের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নকল করে মেধাশুন্যরাই আমাদের থেকে এগিয়ে থাকছেন। প্রশাসনের সঠিক নজরদারি আশা করেন ওই পরিক্ষা কেন্দ্রের মেধাবী পরাক্ষার্থীরা। 

‎অনুসন্ধানে জানা গেছে, কেন্দ্রে অবাধ নকলের সুযোগ করে দেয়ার জন্য বিভিন্ন পর্যায় সম্মানি প্রদান ও কেন্দ্রে কড়াকড়ি না দেয়ার জন্য ঠান্ডা ফি বাবদ টাকা আদায় করেন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। 

‎এ বিষয়ে কেন্দ্র সচিব মো. আকতার সাঈদ খান সাংবাদিকদের সাথে কোন কথা বলতে রাজি হননি। তবে সংবাদ না প্রকাশের জন্য সাংবাদিকদের যাতায়াত খরচ দেয়ার অফার করেন তিনি। 

‎বাকেরগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালনকরা উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. মোজাম্মেল হক বলেন, এখানে বাকেরগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমি দায়িত্ব পালন করছি। পাশাপাশি আমি ট্যাগ অফিসারের দায়িত্বে রয়েছি। আমাদের কেন্দ্রে নকলের কোন সুযোগ নেই। এখানে শতভাগ নকলমুক্ত পরিবেশে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। 

‎গত ২৬ জুন এইচএসসি পরিক্ষা শুরু হয়ে ইতিমধ্যে ৫ টি পরিক্ষা শেষ হয়ে গেলেও বৃহস্পতিবার প্রথম বারের মতো আতাহার উদ্দিন হাওলাদার ডিগ্রি কলেজের কেন্দ্র পরিদর্শনে আসেন বাকেরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও ) রুমানা আফরোজ। এ সময় সেখানে সাংবাদিকরাও উপস্থিত ছিলেন। তবে উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ এই কর্মকর্তাও ঘটনাস্থলে বসে সাংবাদিকদের সাথে কোন কথা বলতে রাজি হননি। পরবর্তীতে মুঠো ফোনে তার সাথে আবারো যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ওখানের মনিটরিং ব্যবস্থা আরো জোরদার করা হবে। 
‎ 

‎এ বিষয়ে বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ইউনুস আলী সিদ্দিকী বলেন, “আপনাদের মাধ্যমে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হলাম। আগামী পরিক্ষা থেকে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের পক্ষ থেকে ওখানে টিম পাঠানো হবে। পাশাপাশি আমি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করবো।”


কালের সমাজ//এসং.র.ন

Side banner
Link copied!