সাত দফা দাবি আদায়ে ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গতকাল শনিবার (১৯ জুলাই) জাতীয় সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তাদের এ সমাবেশে জনতার ঢল নামে। এটি স্মরণকালের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শোডাউন। এর মাধ্যমে দলটি তাদের প্রতি দেশের জনগণের সমর্থন ও জনপ্রিয়তার বিষয়টি জানান দিয়েছে। সেই সঙ্গে আগামী নির্বাচনে অংশ নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নও দেখছেন দলের আমিরসহ বিভিন্ন স্তরের জামায়াত নেতাকর্মীরা। সভাপতির বক্তৃতা দেওয়ার সময় জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আগামীতে আমাদের আরেকটি লড়াই করতে হবে। তাহলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই। আল্লাহর রহমত ও জনগণের ভালোবাসায় জামায়াত ক্ষমতায় গেলে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ উপহার দেওয়া হবে। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হবে তারা, যারা চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে এবং সুশাসনের পক্ষে অবস্থান নেয়।
শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নয়, গতকাল পুরো ঢাকাতেই ছিল জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিপুল উপস্থিতি। সমাবেশ দুপুর ২টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তার ৬ ঘণ্টা আগেই দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উপস্থিতিতে প্রায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ভেতরে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরেও অবস্থান করে দলটির অসংখ্য নেতাকর্মী।
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বাস, ট্রেন ও লঞ্চে করে আসা নেতাকর্মীরা রাজধানীতে এসে মিছিল সহকারে সমাবেশস্থলে প্রবেশ করেন। নেতাকর্মীদের অনেকের হাতে তাদের দলীয় প্রতীক দাাঁড়িপাল্লা শোভা পাচ্ছিল। দাঁড়িপাল্লা ও দলীয় মনোগ্রাম সম্বলিত টি-শার্ট, পাঞ্জাবি পরে এসেছেন অধিকাংশ নেতাকর্মী।
শনিবার ভোর থেকে হাইকোর্ট এলাকা, মৎস্যভবন, শাহবাগ এলাকার বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে, স্বেচ্ছাসেবকরা সবাই একই ধরনের পোশাক পরে বিভিন্ন স্পটে অবস্থান নিয়েছেন। তারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নেতাকর্মীদের সহযোগিতা করছেন। কোন অঞ্চলের মানুষ কোন গেট দিয়ে প্রবেশ করবেন তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন এসব স্বেচ্ছাসেবক।
যে সাত দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে জামায়াত এই জাতীয় সমাবেশের আয়োজন করেছে সেগুলো হলো- অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ, সব গণহত্যার বিচার, প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, ‘জুলাই সনদ’ ও ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন ও এক কোটিরও বেশি প্রবাসী ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এককভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গতকাল জাতীয় সমাবেশ করে জামায়াতে ইসলামী। দুপুর ২টায় কোরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সমাবেশের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এর আগে সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে সাংস্কৃতিক আয়োজনের মাধ্যমে সমাবেশের প্রথম পর্ব শুরু হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করে সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী এবং উপস্থাপনা করেন সাইফুল্লাহ মানসুর।
জামায়াতের জাতীয় সমাবেশে বিএনপি ও এবি পার্টি ছাড়া সমমনা বিভিন্ন দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জাতীয় গণতান্ত্রিক পাটি-জাগপাসহ বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।
বক্তৃতাকালে অসুস্থবোধ করে মঞ্চে লুটে পড়লেন জামায়াত আমির
জাতীয় সমাবেশে বক্তৃতাকালে অসুস্থবোধ করে টানা দুইবার মঞ্চে লুটে পড়েন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। এরপর তিনি বসে বক্তব্য শেষ করেন।
শফিকুর রহমান বলেন, আবু সাঈদরা বুক পেতে না দিলে এই বাংলাদেশ আমরা দেখতাম না। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা যেন তাদেরকে অবজ্ঞা না করি। শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
জামায়াত আমির বলেন, আল্লাহর রহমতে এবং দেশের জনগণের ভালোবাসায় আমরা যদি ক্ষমতায় যাই, তাহলে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করবো। আগামী নির্বাচনে জামায়াতের যেসব প্রার্থী নির্বাচিত হবে, তারা কেউ হাতে টাকা চালাচালি করবে না। সরকারের মন্ত্রীত্ব নিবে না। জামায়াত ক্ষমতায় গেলে প্রভু নয়, জনগণের সেবক হয়ে কাজ করবে। তিনি সারাদেশে জামায়াত মনোনীত প্রার্থীদের দাঁড়িপাল্লায় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান।
জাতীয় নির্বাচনে জয় পাবে চাঁদাবাজবিরোধীরা: ডা. তাহের
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হবে তারা, যারা চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে এবং সুশাসনের পক্ষে অবস্থান নেয়। জামায়াতে ইসলামীর আয়োজনে জাতীয় সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
ডা. তাহের বলেন, “জামায়াতে ইসলামীর আকাঙক্ষা আগামী নির্বাচনে জয় হোক জনগণের। যারা জনগণের পক্ষে, তাদের হাতেই উঠুক বিজয়ের পতাকা। আজকের এই বিশাল সমাবেশই প্রমাণ করে কারা জয়ী হবে।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশকে ভালোবাসে যারা, দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত নয় যারা সেসব শক্তিই ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেবে। সুশাসনের পক্ষের শক্তি আগামী দিনে বিজয়ী হবে।”
জামায়াতের ৭ দফা সমর্থন করে ইসলামী আন্দোলন : অধ্যক্ষ ইউনুস আহমদ
জামায়াতে ইসলামীর ৭ দফা বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন সমর্থন করে বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।
ইউনুস আহমদ বলেন, জামায়াতের দাওয়াত আমরা গ্রহণ করেছি। আমাদের আমির সফরে থাকায় তিনি আসতে পারেননি। তাই আমি এসেছি। তিনি আরও বলেন, আমরা ভবিষ্যতে নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজ করে যাচ্ছি।
বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদীদের জায়গা হবে না: সারজিস
জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদীদের জায়গা হবে না। জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।
সারজিস আলম বলেন, আমরা অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারকে সুশীল সরকার দেখতে চাই না। আমাদের নারীদের অধিকার ও সখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তবে কেউ চাঁদাবাজি করলে আমরা সেটা বলবো।
মজুলমরা আজ জালিম হয়ে উঠছে: নুর
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেছেন, আমরা দেখছি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলেন আমাদের অংশ ছিলো এমন কিছু দল আজ মজলুম থেকে জালিম হয়ে উঠছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।
নুরুল হক নুর বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে হবে। সেই সঙ্গে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে।
আগামীর বাংলাদেশে আমরা চাঁদাবাজি দেখতে চাই না: রাশেদ প্রধান
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) সহ-সভাপতি ও দলীয় মুখপাত্র রাশেদ প্রধান বলেছেন, আগামীর বাংলাদেশে আমরা চাঁদাবাজি দেখতে চাই না। জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় জাতীয় সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।
রাশেদ প্রধান বলেন, আগামীর বাংলাদেশে আমরা পাথর দিয়ে হত্যা করাও দেখতে চাই না।
তিনি আরো বলেন, একটি দল আবারও আওয়ামী লীগের স্লোগান ফিরে আনতে চাচ্ছে। তাদেরকে আওয়ামী লীগের কথা মনে রাখতে হবে।
ন্যায়বিচার চাই-আবরারের বাবা
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নিহত শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত পূর্ণ বিচার পাননি বলে দাবি করেছেন তার বাবা বরকত উল্লাহ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতে ইসলামীর আয়োজিত জাতীয় সমাবেশে বক্তৃতাকালে তিনি এ কথা বলেন।
বরকত উল্লাহ বলেন, “২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আমার ছেলে আবরার ফাহাদকে রাতভর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। তার একমাত্র অপরাধ ছিল, সে দেশের স্বার্থে কথা বলেছিল। ভারতীয় আধিপত্য এবং তৎকালীন সরকারের সঙ্গে ভারতের কিছু চুক্তির বিষয়ে সমালোচনামূলক ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়াই তার প্রাণ নেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।”
তিনি বলেন, “আবরার লিখেছিল ভারত গোপনে ফেনী নদীর পানি নিচ্ছে, অথচ আমরা পর্যাপ্ত ইলিশ পাচ্ছি না। বরং আমাদের ইলিশ কম দামে ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। এমন সত্য উচ্চারণই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শেখ হাসিনার সরকারের বৈষম্যমূলক একতরফা নীতিই এর পেছনে দায়ী।”
বরকত উল্লাহ বলেন, “আজ ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও আমি আমার ছেলের হত্যার বিচার পাইনি। একজন বাবা হিসেবে আমি কেবল ন্যায়বিচার চাই। বিচার প্রক্রিয়া এখনো সম্পূর্ণ হয়নি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।”
তিনি আরও বলেন, “আজও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে র্যাগিংয়ের মতো বর্বরতা চলে আসছে। এখন যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে, আমি প্রশ্ন রাখি কেন এই ধরনের সহিংসতা বন্ধ হবে না?”
ছাত্ররাজনীতির নামে সংঘটিত সহিংসতার শিকার তরুণদের স্মরণ করে বরকত উল্লাহ বলেন, “জুলাই-আগস্টে যেসব তরুণ শহীদ হয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের তালিকা তৈরি করেছে এটা প্রশংসনীয়। কিন্তু যারা ছাত্রলীগের র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে, তাদের কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। আমি আহ্বান জানাই, এই হত্যাগুলোরও একটি রাষ্ট্রীয় তালিকা প্রণয়ন করা হোক।”
সন্তানহারা এক বাবার কণ্ঠে ক্ষোভ, বেদনা ও আবেদন মিশে বরকত উল্লাহ বলেন, “আমার ছেলে তার দেশকে ভালোবেসেছিল। দেশের স্বার্থে কথা বলেছিল, সেটাই ছিল তার অপরাধ। আমি ন্যায়বিচার চাইছি বারবার, কিন্তু আজও সে দাবি পূরণ হয়নি। আমি দেশের বিবেকবান মানুষের কাছে আবেদন জানাই, দয়া করে আবরারের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করুন।”
কালের সমাজ/হাকা
আপনার মতামত লিখুন :