গাজীপুরের শ্রীপুরে নদী দখল ও দূষণের অভিযোগে অভিযুক্ত এক্স সিরামিকস কারখানাকে ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি’ অ্যাওয়ার্ড দেওয়ায় ফুসে উঠছে পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনসহ শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ। তারা নিজ নিজ ফেসবুক আইডি থেকে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে করছেন সমালোচনা। পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠণের পক্ষ থেকে ওই কারখানার ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড’ প্রত্যাহারসহ নদীর দখলকৃত জায়গা ফেরত দেওয়া ও কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়।
গাজীপুরের শ্রীপুরের লবলং নদী দখল ও দূষণ করা এবং হাজার হাজার বিঘা কৃষি জমি নষ্টের পরও এক্স সিরামিক্স শিল্প প্রতিষ্ঠানকে গ্রিন অ্যাওয়ার্ড দেওয়ায় নিন্দা এবং পুরষ্কার পুন:বিবেচনার জন্য শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টা বরাবর যৌথ আবেদন করেন পরিবেশবাদী ও সামাজিক ৪টি সংগঠন।
মঙ্গলবার (৮ জুলাই) দুপুরে বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল, রিভার এন্ড নেচার ফাউন্ডেশন, শ্রীপুর সাহিত্য পরিষদ এবং উপজেলা দুর্ণীতি প্রতিরোধ কমিটির নেতৃবৃন্দসহ শিক্ষক ও সাংবাদিক শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ব্যারিস্টার সজীব আহমেদের মাধ্যমে শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টা বরাবর এ আবেদন জানান।
এক্স সিরামিকস কারখানাটি গাজীপুরের শ্রীপুর পৌসভার ৯নং ওয়ার্ডের বহেরারচালা এবং মাওনা ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের উত্তর বেলতলী গ্রামের অবস্থিত। গত ২৪ জুন রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড-২০২৫’ দেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন শিল্প এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। বেশ কয়েকটি কারখানাসহ ওই কারখানাকেও গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড সম্মাননা প্রদান করা হয়।
স্থানীয়রা জানায়, ২০০৯ সালে ৭৫ বিঘা জমি নিয়ে শ্রীপুর পৌসভার ৯নং ওয়ার্ডের বহেরারচালা এবং মাওনা ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের উত্তর বেলতলী গ্রামে গড়ে ওঠে এক্স সিরামিক কারখানা। নির্মাণের শুরুতে কারখানাটি শ্রীপুরের কৃষিজ সম্পদ, ভূগর্ভস্থ পানি ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের আঁধার লবলং নদীটিকে ইচ্ছেকৃতভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে লবলং নদী দখল শুর করে। দখলের ফলে বর্তমানে নদীটি খালে পরিণত হয়েছে। সাপের মতো এঁকেবেঁকে কারখানা কর্তৃপক্ষের ইচ্ছেমতো গতিপথ পরিবর্তন করেছে। গতিপথ পরিবর্তনের ফলে জলাবদ্ধতারও সৃষ্টি হচ্ছে। খালের কয়েকটি পয়েন্টে তৈরি করেছে অস্থায়ী ব্রিজ। কারখানার ভেতর খালের ওপর কালভার্ট নির্মাণ করে দুই পাড়’কে যুক্ত করে চলছে কারখানার বিভিন্ন গাড়ি। কারখানার সকল তরল বর্জ্য নদীতে ফেলার কারণে এখন অস্তিত্ব বিলীনের পথে নদীটি। কারখানাটি লবলং নদীকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরার কারণে নদী রক্ষা করা নিয়ে শঙ্কিত পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনসহ শিক্ষক ও এলাকাবাসী।
রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মনির হোসেন বলেন, যে কারখানা আমাদের প্রাণের নদী লবলংকে গিলে ফেলেছে তাকে দেওয়া হয়েছে সম্মাননা। তিনি তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, আসলে দোষ কাকে দেবেন? আশ্চর্য ও হতবাক হয়েছি। যে কারখানা আমাদের প্রাণের নদ লবলঙ্গকে গিলে ফেলেছে, তাকে দেওয়া হয়েছে সম্মাননা! সরকারের পরিবেশবান্ধব শিল্প উদ্যোগের স্বীকৃতিস্বরূপ এই সিরামিক কারখানা ২০২৫ সালের গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। শাবাস শ্রম মন্ত্রণালয়! আমরা শ্রম মন্ত্রণালয়ের ওই অ্যাওয়ার্ড কমিটির এমন বিতর্কিত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
রিভার এন্ড নেচার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বলেন, এই কারখানার কারণে উজানে শতাধিক বিঘা জমিতে দূষিত পানি জমে থাকায় প্রায় এক যুগ যাবৎ চাষাবাদ দূরের কথা, কৃষক জমিতেই নামতে পারে না। দিনদিন এ কারখানার দখল ও দূষণের ভয়াবহতা বেড়েই চলেছে। তিনি তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, এক্স সিরামিকসে একাধিকবার গিয়েছিলাম। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান হাওলাদার, সর্বশেষ গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকও (রাজস্ব ও এলএ) মোহাম্মদ কায়সার খসরু গিয়েছিলেন। কারখানার ভেতরে-বাইরে গ্রিন বলে কিছু চোখে পড়েনি। তবে এ কারখানা লবলঙ্গ দূষণ ও দখলকারী, এটা ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছে প্রমাণিত হয়েছে। যখন শুনলাম সেই কারখানা এ বছর গ্রিন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে, তখন আশ্চর্য হলাম। সঙ্গে সঙ্গে হতাশাও বেড়ে গেল। এরপর যদি কিছু করার থাকে, তবে সেটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপর ছেড়ে দিলাম।
বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল শ্রীপুর উপজেলা শাখার সভাপতি সাঈদ চৌধুরী তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, এক্স সিরামিকস গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে! এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। জবাব চাই, কারা ছিল এই পুরস্কার কমিটিতে? তিনি আরও লিখেছেন, যে ফ্যাক্টরির জন্য হাজার হাজার বিঘা জমি চাষের অনুপযোগী, যাদের জন্য একটি এলাকার ভূগর্ভস্থ পানি হুমকির মুখে, যাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, সেই ফ্যাক্টরি পেল গ্রিন অ্যাওয়ার্ড!
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এক্স সিরামিকস কারখানার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মাসুদুর রহমান তালুকদার শামীম বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা প্রতি মাসেই আমাদের কারখানা ভিজিট (পরিদর্শন) করে। আমরা ২০০৯ সাল থেকেই ইটিপি এক্সিকিউট করি এবং সচল। ইটিপি থেকে যে ¯øাষ বের হয় এটা ‘র’ মেটারিয়ালসের এগিনেষ্টে ব্যবহার করি। এটা আমরা ফেলে দেয় না। আমাদের কারখানার ব্যবহৃত পানিসহ কোনো পানি খালে যায় না। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে বিভিন্নভাবে তদন্ত এবং পরীক্ষা করে দেখেছে। আমাদের ইটিপি পার আওয়ার তিন লাখ লিটার ক্যাপাসিটি রয়েছে। ক্যানেলের বাহিরের চওড়ার চেয়ে আমাদের কারখানার ভিতরে ক্যানেলের চওড়া আরো বেশি এবং কোনো বাধা নাই।
গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আরেফিন বাদল বলেন, আমার জানামতে গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড দিয়ে থাকে শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রণালয়। এটি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আসার পরপরই পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি প্রতিনিধি দল এক্স সিরামিক কারখানা পরিদর্শন করেছে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পাঠানো হবে। কারখানার ছাড়পত্রের আবেদন স্থগিত রাখা হয়েছে। কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে, তারা কোনো জবাব দেয়নি।
কালের সমাজ/ কা.আ./ সাএ
আপনার মতামত লিখুন :