ভালো বেতন ও উন্নত জীবনের প্রলোভনে ইতালি যাওয়ার আশায় মাদারীপুরের অর্ধশতাধিক যুবক এখন নিখোঁজ কিংবা লিবিয়ায় মাফিয়ার হাতে জিম্মি। তাদের পরিবারের অভিযোগ—ইউরোপে পাঠানোর নামে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা, নির্যাতনের শিকার যুবকদের ভিডিও পাঠিয়ে আদায় করা হচ্ছে মুক্তিপণ। এই মানবপাচার চক্রের মূল হোতা বলে অভিযুক্ত জামাল কারিকর। তিনি মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া গ্রামের আলাই কারিকরের ছেলে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, জামাল দীর্ঘদিন ধরে ভয়ঙ্কর এক মানবপাচার সিন্ডিকেট পরিচালনা করে আসছেন। তার বিরুদ্ধে মাদারীপুর সদরসহ বিভিন্ন থানায় অন্তত ১০টির বেশি মামলা রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব ও আইনের ফাঁক গলে প্রতিবারই তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে আবারও একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। তার বিরুদ্ধে যেসব ভুক্তভোগী মামলা করেছেন, তাদেরই উল্টো মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিরখাড়া ইউনিয়নের ঘুনসি গ্রামের কলেজছাত্র হাসান হাওলাদার ২০২২ সালে ভাগ্য ফেরাতে দালাল জামালের সঙ্গে ১৩ লাখ টাকার বিনিময়ে ইতালি যাওয়ার চুক্তি করেন। প্রথমে দুবাই, পরে লিবিয়ায় নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয় মাফিয়ার কাছে। সেখান থেকে বাড়িতে পাঠানো হয় নির্যাতনের ভিডিও। পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয় আরও ৫ লাখ টাকা। তার পরিবারের সঙ্গে বর্তমানে কোনো যোগাযোগ নেই।
একই গ্রামের রুহুল আমিন শেখ দালাল চক্রের নির্যাতনে মারা গেছেন বলে দাবি এলাকাবাসীর। মিন্টু হাওলাদার নামের আরেক যুবক ১৮ মাস আগে দেশ ছেড়েছেন। তার পরিবার ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়েও এখনো ছেলের কোনো সন্ধান পায়নি। মিঠু দাস, বৃদ্ধ শাহ আলমসহ আরও অনেকেই একই দালালচক্রের শিকার হয়েছেন।
হাসান হাওলাদারের বাবা হায়দার হাওলাদার বলেন, “আমার ছেলেকে লিবিয়ায় আটকে রেখে ১৫ লাখ টাকা আদায় করেছে। মামলা করায় জামাল উল্টো আমার নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটিয়েছে।”
মিন্টু হাওলাদারের মা সাবিনা বেগম বলেন, “জামাল আমার ছেলেকে মাফিয়ার হাতে তুলে দিয়েছে। এমন শত শত ছেলের জীবন ধ্বংস করেছে।”
ভুক্তভোগী শাহ আলম মাতুব্বর বলেন, “ইতালি পাঠানোর নাম করে ১২ লাখ টাকা নিয়েছে। পরে লিবিয়ার মরুভূমিতে আটকে রেখে আমাকে চাবুক দিয়ে পেটানো হয়েছে। আমি তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।”
অভিযুক্ত জামাল কারিকর অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে। আমি কাউকে হুমকি দেইনি। আমি একজন ব্যবসায়ী।” তিনি দাবি করেন, নিজের ছেলেকেও অনেক টাকা খরচ করে ইতালি পাঠিয়েছেন।
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর সাহা বলেন, “মানবপাচারকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকে ভয়ভীতি দেখিয়ে রেহাই পাওয়া যাবে না।”
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াদিয়া শাবাব জানান, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দালালদের তালিকা করা হয়েছে। শিগগিরই এ তালিকা জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে টানানো হবে।”
স্থানীয়দের দাবি, জামাল কারিকরের নেতৃত্বে গঠিত মানবপাচার চক্র লোভনীয় স্বপ্ন দেখিয়ে শত শত পরিবারকে নিঃস্ব করেছে। আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে বহু বছর ধরে এই অপরাধ সাম্রাজ্য টিকিয়ে রেখেছে। এখন সময় হয়েছে জামালের মতো চক্রগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের, যেন আর কেউ এমন বিভীষিকাময় পরিস্থিতির শিকার না হয়।
কালের সমাজ//র.ন
আপনার মতামত লিখুন :