চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির নেতৃত্বে বড় ধরনের রদবদলের আভাস পাওয়া গেছে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, কমিটি বিলুপ্তি ও সাংগঠনিক স্থবিরতা কাটিয়ে নতুনভাবে দলকে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় বিএনপি। এই প্রেক্ষাপটে আলোচনায় উঠে এসেছে একাধিক নেতার নাম, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লায়ন আসলাম চৌধুরী, প্রবীণ নেতা এসএম ফজলুল হক, শিল্পপতি সরওয়ার আলমগীর, সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ হালিম, কুতুবউদ্দিন বাহার ও ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেন।
দলীয় সূত্র বলছে, এসব নেতার সাংগঠনিক দক্ষতা, অতীত ভূমিকা, গ্রহণযোগ্যতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার যোগ্যতাই তাদের সম্ভাব্য নেতৃত্বে নিয়ে এসেছে। কেন্দ্র ইতোমধ্যে প্রত্যেকের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে এবং মূল্যায়নের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলালকে ওই তদন্ত কমিটির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক রাউজান সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত এই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই ঘোষণা আসবে নতুন নেতৃত্ব।
উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) রাউজানের সর্তারঘাট এলাকায় গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খন্দকার অনুসারীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। এতে অন্তত ৩০ জন আহত হন এবং গুলিবিদ্ধ হন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও তৎকালীন আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার।
এই ঘটনার জেরে কেন্দ্রীয় বিএনপি দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে আহ্বায়ক কমিটি বাতিল করে এবং গিয়াস কাদের চৌধুরীর ভাইস চেয়ারম্যান পদ স্থগিতসহ আরও পাঁচ নেতাকে বহিষ্কার করে। দলের অভ্যন্তরে এটি ছিল একটি বড় ধরনের সাংগঠনিক ধাক্কা, যার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে নেতৃত্ব পুনর্গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়।
সম্ভাব্য নেতৃত্বে আলোচনায় যাঁরা:
লায়ন আসলাম চৌধুরী: সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ও উত্তর জেলা বিএনপির শক্তিশালী নেতা হিসেবে ২০০১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার সময়ে দল ছিল ঐক্যবদ্ধ, গতিশীল ও সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। ২০১৬ সালে রাষ্ট্রবিরোধী মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘ ৮ বছর কারাবরণ করেন। ২০২৪ সালে মুক্তির পর কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে পুনরায় সক্রিয় হন। যদিও তিনি আপাতত দায়িত্ব নিতে কিছুটা অনীহা প্রকাশ করেছেন, তারপরও হাইকমান্ড তার ওপর আস্থা রাখতে আগ্রহী।
এসএম ফজলুল হক: উত্তর চট্টগ্রামের এক বয়োজ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞ নেতা। দলীয় শৃঙ্খলা ও ঐক্যের প্রশ্নে বরাবরই দৃঢ় অবস্থানে ছিলেন। কেন্দ্র তার নিরপেক্ষতা ও ভারসাম্যপূর্ণ নেতৃত্বকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে।
আলহাজ্ব সরওয়ার আলমগীর: সদ্যসাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও শিল্পপতি। সংগঠনের প্রতি নিবেদন, মাঠ পর্যায়ে সক্রিয়তা এবং কর্মীবান্ধব ভাবমূর্তির কারণে তৃণমূলে তার জনপ্রিয়তা রয়েছে। অনেক নেতাকর্মী মনে করছেন, তাকে সদস্য সচিব করলে কার্যকর ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব নিশ্চিত হবে।
এম এ হালিম: সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। সংগঠনকে টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমানে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে তার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
কুতুবউদ্দিন বাহার: দলের বিভিন্ন সময়ে রাজপথে সক্রিয় থেকেছেন। সংগঠনের দুর্দিনেও ছিলেন মাঠে। সাংগঠনিক অভিজ্ঞতার কারণে সম্ভাব্যদের তালিকায় তার নামও আছে।
ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেন: সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শান্ত ও কর্মীবান্ধব নেতৃত্বের জন্য তিনি তৃণমূলে প্রশংসিত। দায়িত্ব নিতে তিনি প্রস্তুত আছেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
উত্তর জেলা বিএনপির দীর্ঘদিনের গোষ্ঠীগত কোন্দল, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও জনসমর্থনের অবক্ষয়ের বিপরীতে একজন বলিষ্ঠ, সৎ, অনুপ্রাণিত নেতা প্রয়োজন—যিনি দলকে ঐক্যবদ্ধ ও গতিশীল করতে পারবেন। নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা—নতুন নেতৃত্ব ত্যাগীদের মূল্যায়ন করবেন, চাঁদাবাজ-অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিহত করবেন এবং জনগণের কাছে দলকে পুনরায় গ্রহণযোগ্য করে তুলবেন।
তদন্ত প্রতিবেদন, কেন্দ্রীয় পর্যায়ের মূল্যায়ন ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তের পরই চূড়ান্ত ঘোষণা আসবে। সকলের দৃষ্টি এখন বিএনপির কেন্দ্রের দিকে—একটি সাহসী ও সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত কি এবার চট্টগ্রাম উত্তর জেলায় বিএনপিকে আবারও সংগঠিত ও শক্তিশালী করতে পারবে, সেটিই এখন রাজনীতির আলোচিত প্রশ্ন।
কালের সমাজ//র.ন
আপনার মতামত লিখুন :