শারদকাল মানেই বাঙালির জীবনে দুর্গাপূজার আগমন। মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ভরাট কণ্ঠে বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্যের লেখা মহিষাসুরমর্দিনী স্ত্রোত্র শোনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় পূজার আচার। কিন্তু দুর্গা পূজা কি শুধুমাত্র বাঙালির উৎসব? ইতিহাস জানায়, এটি সর্বসনাতনীর একটি পূজা, যদিও আচার, নাম এবং অঞ্চলের ভিত্তিতে পার্থক্য থাকে।
দেবী দুর্গাকে বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন নামে পূজা করা হয়—কাশ্মীরে ও দক্ষিণ ভারতের কিছু অঞ্চলে অম্বা বা আম্বিকা, গুজরাটে হিঙ্গুলা ও রুদ্রাণী, উত্তর প্রদেশে কল্যাণী, বিহার ও ঝাড়খণ্ডে উমা, তামিলনাডুতে কন্যাকুমারী, আর বাঙালির কাছে মা দুর্গা।
দেবী দুর্গার আদ্যাশক্তি
দেবী দুর্গা হলো আদ্যাশক্তির রূপ, যেখানে বিদ্যা ও অবিদ্যা একত্রিত। বিদ্যা মানুষের দয়া, ভক্তি ও প্রেমের পথে নিয়ে যায়, আর অবিদ্যা মানুষকে মুগ্ধ করে রাখে। বিভিন্ন পুরাণ ও তন্ত্রে তাকে মহামায়া, কালী, জগদ্ধাত্রী, চামুণ্ডা ইত্যাদি রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
মহিষাসুরবধ: দেবী দুর্গার তিনটি প্রধান রূপ—উগ্রচণ্ডা, ভদ্রাকালী, দশভুজা দুর্গা—মহিষাসুরকে তিনবার তিনকল্পে হত্যা করেন।
অন্য অসুরবধ: মধুকৈটভ অসুর বধের জন্য তিনি মহাকালী, শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করেন কৌষিকী রূপে।
নবদুর্গা: দেবীর সন্তানরা চারটি শক্তির প্রতীক—কার্তিক (ক্ষাত্রশক্তি), গণেশ (শ্রমশক্তি), সরস্বতী (জ্ঞানশক্তি), লক্ষ্মী (ধনশক্তি)।
দুর্গাপূজার প্রাচীনত্ব
দুর্গাপূজার ইতিহাস সহজভাবে বলা সম্ভব নয়। বিভিন্ন পুরাণে ও ঐতিহাসিক সূত্রে এর উদ্ভবের বর্ণনা আছে।
দেবীমাহাত্ম্য: মহিষাসুর বধের জন্য দেবী দুর্গার উদ্ভব।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ: প্রথম দুর্গাপূজা করেন কৃষ্ণ, দ্বিতীয়বার ব্রহ্মা, তৃতীয়বার শিব।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ: বাঙালিতে দুর্গাপূজার অস্তিত্বের প্রমাণ।
হরপ্পা ও চন্দ্রকেতুগড় সভ্যতা: মাতৃকা উপাসনার মাধ্যমে দুর্গাপূজার প্রাচীনতা।
বাংলায় দুর্গাপূজার আধুনিক আচার শুরু হয় মধ্যযুগে। রাজা সুরথ, রাজা গণেশ, কাশিমবাজারের রাজবাড়ি, শোভাবাজার ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় পূজার আয়োজন হয়েছে।
দুর্গা পূজার শাস্ত্রীয় ও প্রণালীগত দিক
পূজা বাহ্য ও আভ্যন্তরিক; বাহ্যপূজা আবার বৈদিক ও তান্ত্রিক।
নবপত্রিকা পূজা: নয়টি উদ্ভিদ প্রতিটি দেবীর প্রতীক। উদাহরণ: কলা (ব্রাহ্মণী), কচুর (কালী), হলুদ (দুর্গা), বেল (শিবা), ধান (লক্ষ্মী)।
সন্ধিপূজা: অষ্টমীর শেষ ২৪ মিনিট ও নবমীর প্রথম ২৪ মিনিটে অনুষ্ঠিত হয়। শ্রীরামচন্দ্র রাবণকে বধ করেছিলেন এই সময়।
কুমারী পূজা: বেদ-পুরাণে উল্লেখিত, নারীকে দেবী রূপে পূজা করা হয়।
মাহাত্ম্য
দেবী দুর্গা জীবনের মহাবিপদ থেকে উদ্ধারকারী, দারিদ্র্য, রোগ ও শোক দূরকারী শক্তির প্রতীক। চণ্ডীতে বলা আছে, “দারিদ্র্যদুঃখভয়হারিণী কা ত্বদন্যা”—অর্থাৎ মানুষের জীবনের সব মহাবিপদ থেকে তিনি রক্ষা করেন।
দুর্গাপূজা কেবল উৎসব নয়; এটি মানুষের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক শক্তি, মাতৃত্ব ও নারীশক্তির পূজার মাধ্যম, যা ভারতীয় ও বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণময় অংশ।
কালের সমাজ // র.ন
আপনার মতামত লিখুন :